মারুফ মল্লিক: ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় থাকা অনেক পরিবারের সঙ্গে আবরারের পরিবারও যুক্ত হলো। কিন্তু বিচার পাবে কি? কঠিন খুনে, আশাহীন সমাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করছি আমরা। কে কখন কাকে ধরে নিয়ে হত্যা করবে, বলা মুশকিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের সহপাঠীকে মেরে ফেলছেন সতীর্থরা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলছে আরেক দল। নিজ দলের কর্মীও প্রতিহিংসা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ব্লগারদের মেরে ফেলা হচ্ছে ধর্মের নামে। স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করছে। গণমাধ্যমের কর্মীদের সামনেই পথচারী দরজিকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। নির্যাতিতের স্বজনের হাহাকার ও বিলাপে ভেসে যাচ্ছে এই মানবজমিন। ঘৃণা, দ্বেষ ও হিংস্রতার সঙ্গে নিত্য বসবাস।
আবরারের হত্যাকাণ্ডে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের টক শোগুলোয় কথার তুবড়ি ছোটাবেন একেক বক্তা। কেন মারা হলো, কে কে মারল, আবরার কোন দল করতেন—এসবের ব্যবচ্ছেদ হবে। একসময় নতুন ঘটনায় চাপা পড়ে যাবেন আববার। আবরারের খুনিরা ছাড়া পেয়ে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর পদ অলংকৃত করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবরারকে একদিন আমরা ভুলে যাব কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড সামাজিক অধঃপতনের ইঙ্গিত দেয়। এই ইঙ্গিত ভয়াবহ। সমাজ ভেঙে পড়ার ইশারা এ ঘটনায় বিদ্যমান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার কারিগর তৈরির কারখানা। এই কারিগরেরাই যদি খুনি-ধর্ষক হিসেবে বের হন, তবে রাষ্ট্র হিসেবে শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়ানো কঠিন। রাষ্ট্র যেই জমিনের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, সেই জমিন যদি খুবই নরম হয় তবে টিকে থাকা কঠিন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই জমিন শক্ত হচ্ছে না কেন? নাকি জমিনকে পরিণত ও জমাট হতে দেওয়া হচ্ছে না উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। বাংলাদেশ যদি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে না পারে, তবে লাভবান হবে কারা বা কোন দেশ? দ্বিধাবিভক্ত, বিভাজিত বাংলাদেশ থেকে কারা বেশি সুবিধা আদায় করে নিতে পারে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জমিন কতটা পরিণত ও পোক্ত হলো, এই প্রশ্ন জাগা হতাশাজনক। এমনকি অবান্তরও মনে করতে পারেন অনেকে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে যে জায়গায় আমাদের পৌঁছানোর কথা ছিল, সেখানে আমরা যেতে পারিনি। বরং ঘৃণাবাদকে উসকে দিচ্ছে।
আবরার ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। কোনো সমাজেই সবাই একমত হবে না। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। সমাজ কাঠামোর ভেতরেই এই ভিন্নতার নিয়ম লুকিয়ে আছে। তাই ভিন্নমতকে রাষ্ট্র স্বাগত জানাবে। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে রাষ্ট্র। যখন রাষ্ট্র এই ধরনের চর্চা থেকে বের হয়ে আসে, তখনই জনগণ এ ধরনের লেখালেখি বাড়িয়ে দেন। কিছু রাষ্ট্র পছন্দ করবে, কিছু করবে না। তাই বলে মেরে ফেলবে না। আবরার রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করলে বিচারে তাঁর সাজা হতে পারে। কিন্তু আবরারের মতামতকে বুয়েট ছাত্রলীগের পছন্দ হয়নি। শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষের ছাত্রলীগের আদালতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায় আবরারের। ছাত্রলীগ কি রাষ্ট্র বা তার অংশ?
এ ঘটনায় কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে বটে কিন্তু জনসাধারণ আশ্বস্ত হতে পারছে না।
কারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। হাতুড়ি দিয়ে মারধর করার পর পিটুনি-বীর আবদুল্লাহ বীরপর্দে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন হাসি মুখে। কিন্তু আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেউই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
দিনদুপুরে বিশ্বজিৎ খুন হয়েছিলেন ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে। বিশ্বজিতের খুনিদের অনেকে আরামেই আছেন। তাঁদের নাম অভিযোগপত্রেই আসেনি বলে ওই সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের আসামিরা সবাই পলাতক বলা হচ্ছে। সাজা কার্যকর করা যায়নি। অথচ খুনিদের ক্যাম্পাসে নিয়মিতই যাতায়াত ছিল।
মোটের ওপর রাষ্ট্র যেন বিচারহীন এক নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সারা দেশে যুবলীগের নির্যাতনকেন্দ্র কতগুলো বলা মুশকিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটি আতঙ্কের নাম। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের অনেক নির্যাতনকক্ষ ছিল, যেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। শিবিরের এই ধারা চারদলীয় জোট সরকারের আমল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ৯০-এর শুরুতে বিএনপির আমলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এখন ছাত্রলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপে সব কটি ক্যাম্পাসই যেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এর আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় বুয়েটে এক শিক্ষার্থীও নির্যাতনের শিকার হন ছাত্রলীগের হাতে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্যাতন, হত্যা, হামলার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে এসে লাশ হয়ে কাফনে মুড়ে বাড়ি ফেরা আর কত দিন চলবে? এই লাশের তালিকায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছেই। বুকে পাষাণ চেপে সন্তানহারা পিতা লাশের কফিন নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। এ এক ভয়ংকর যাত্রা। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে অধিকাংশ অভিভাবককে যে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়, তা আমাদের অধিকাংশেরই জানা। দীর্ঘদিনের শ্রম ও ঘামকে পানি করে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেন পিতামাতা। সন্তানকে রাষ্ট্রের কারিগর হওয়ার জন্য পাঠান যে বড় হয়ে পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের খুঁটিটাকে শক্ত করে ধরবে, লাশের ভারী কফিন বাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য না। কিন্তু রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ কারিগরদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তাই খুন হয়ে যায় আবরার, দ্বীপ, সাদ, জুবায়ের, আবু বকর। প্রাণের কী মর্মান্তিক অপচয়! রাষ্ট্র তার কারিগরদের খুন করাচ্ছে, খুনিও বানাচ্ছে!
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন