ঢাকা: পলাশীর মোড়ে পুলিশ গিজ গিজ করছে। ওই যে তিতুমীর হল, শেরেবাংলা হল। আমাদের স্মৃতির ক্যাম্পাস। আমাদের ভালোবাসার ক্যাম্পাস। কত স্মৃতি এই ক্যাম্পাস ঘিরে! বিআরটিসির বাস ধরব বলে রংপুরের বাসা থেকে ভোর পাঁচটায় বের হতাম দুই ভাই, আম্মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন; হলে ঢুকে চিঠি লিখতাম, আম্মা, ঠিকভাবে পৌঁছেছি। বুয়েটের হল মানে নিরাপদতম স্থান ছিল তখন। আম্মা নিশ্চিন্ত হতেন। সে আশির দশকের কথা।
আর ২০১৯ সালের অক্টোবরে কুষ্টিয়ার আবরার ফাহাদও বুয়েটের হলে পৌঁছে মাকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছিলেন নিরাপদে পৌঁছানোর কথা। ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই তিনি হয়ে গেলেন লাশ। পরদিন তাঁর লাশ ফিরে গেল কুষ্টিয়ায় মায়ের কাছে। কী সাংঘাতিক ঘটনা!
ভাবতে ভাবতে পাড়ি দিলাম শেরেবাংলা হল। রোববার রাতে যে হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আবরারকে। হত্যা করেছে যারা, তারাও বুয়েটেরই ছাত্র। আবরারের অপরাধ, ফেসবুকে এমন কথা বলা, যা ‘ভাইদের’ জন্য পছন্দনীয় নয়।
বুয়েটের শহীদ মিনারে পৌঁছুলাম। ‘কথা বলতে দাও’, ‘লিখতে দাও’—শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে বড় বড় অক্ষরে পোস্টার লিখছেন দুই তরুণ। বিক্ষোভ–সমাবেশ হচ্ছে। স্লোগান উঠছে। এই দুই তরুণ স্লোগানে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। আবার পোস্টারে লিখছেন এই সময়ের তারুণ্যের দাবিও, ‘কথা বলতে দাও’। গতকাল বেলা ১১ টা। শিক্ষার্থীরা একটু আগে একটা বড় মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে এলেন। তাঁরা বসেছেন শহীদ মিনারের চত্বরে।
তাঁরা স্লোগান ধরেছেন: ‘ব্যান স্টুডেন্ট পলিটিকস। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ করো। আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি চাই না।’ তাঁরা আবরার হত্যার বিচার চান। অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা চান। তাঁদের চোখে–মুখে ফুটে উঠছে দুঃখ ক্ষোভ হতাশা। একবার কোনো তরুণ রাগে চিৎকার করে উঠছেন। একবার কোনো তরুণী দুঃখে কেঁদে ফেলছেন।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও এসেছেন আবরার হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানাতে। একটা ব্যানার নিয়ে ছাত্রসমাবেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। তাঁদের একজন বলছেন, ‘বুয়েটের এক ছাত্র আরেক ছাত্রের গায়ে হাত তুলবে, মাথার ওপরের তলার রুমে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মারধর করবে, এটা আমাদের কাছে অকল্পনীয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, একজন বুয়েটিয়ান যদি শোনেন আরেকজন বুয়েটিয়ান এসেছেন, চেনা–পরিচয় লাগে না, তাঁরা পরস্পরের কাছে ছুটে আসেন। আমরা তো এমনটাই দেখে এসেছি। এ কোন বুয়েট? এ কিসের রাজনীতি?’
সমাবেশের আরেক পাশে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখ ছলছল করছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কেন এসেছেন?’ ‘আমি একজন মা। আবরারের সঙ্গে পড়ে আমার ছেলে। ছুটির দিন ছেলে এসেছে সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদ করতে। আমি তার সঙ্গে চলে এসেছি। এই মা শোক করছেন একজন মায়ের কোল খালি হয়েছে বলে, আবার একই সঙ্গে নিজের ছেলেকে একা ছেড়ে দিতে ভরসা পাননি, ছেলের সঙ্গে চলে এসেছেন ক্যাম্পাসে। হায়, বুয়েটে সন্তানকে পাঠিয়ে মাকে ভাবতে হচ্ছে সন্তানের নিরাপত্তার কথা! শিক্ষকদের কেউ কেউ এসেছেন। শিক্ষার্থীদের সমাবেশের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। সংহতি জানাচ্ছেন নীরবেই।
একজন শিক্ষক আমাকে বললেন, ‘এই ঘটনা আজকেই প্রথম নয়, প্রায়ই এ রকম মারধর হয়। রুমে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার হয়। আজকে একজন মারা গেছে বলে আপনারা এসেছেন, তা না হলে জানতেও পারতেন না।’ একজন ছাত্রী এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘র্যাগিংয়ের নামে কী হয়, আপনারা জানেন না। নবাগত শিক্ষার্থীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়।’
ছাত্রদের প্রচণ্ড ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ভিসি স্যার কোথায়? তিনি কেন আসছেন না? ছাত্ররা জানতে চাইছেন। স্থাপত্যের একজন শিক্ষক জানালেন, ‘কিছুদিন আগে ডিপার্টমেন্টের একটা কক্ষে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে র্যাগিংয়ের নামে পিটুনি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনকে জানালে তারা বলেছে, আপনারা ম্যানেজ করেন। একটু একটু করে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি এক দিনে খারাপ হয়নি।’
আমার আকাশ থেকে পড়ার দশা। আমাদের সময়ে বুয়েটে প্রথম বর্ষের নবীনদের ফুল দিয়ে বরণ করা হতো। ছাত্রসংগঠনগুলো সংবর্ধনা দিত। কে কত আদর করবে নবীনদের, তার প্রতিযোগিতা হতো। সেই বুয়েটে র্যাগিং এল কোত্থেকে?
শুধু বুয়েটে নয়, দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটা এখন প্রধান সমস্যা। র্যাগিংয়ের কারণে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন নবীন শিক্ষার্থী, এই অভিযোগ আছে। নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতনের ঘটনাও আছে। এটা এখনই কঠোরভাবে দমন করা উচিত।
আর? কথা বলতে দিতে হবে। অপরের মতকে শ্রদ্ধা জানাতে দিতে হবে। কেউ কারও গায়ে ফুলের আঘাতও দেবে না। এবং যে দাবি এখন প্রবল তা হলো, দলীয় রাজনীতি ক্যাম্পাসে বন্ধ করে দিতে হবে।
ছাত্ররা স্লোগান তুলেছেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ করো, বন্ধ করো।’
আমার কান্না পাচ্ছে। এই ক্যাম্পাসে কত কী করেছি। কোনো দিন মনে হয়নি, কেউ আমাকে আঘাত করতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতি করত যারা, তারা এত বছর পরও সবাই সবার বন্ধু। বুয়েট নিয়ে কত গর্ব আমাদের। সারা দেশের মেধাবীতম ছেলেমেয়েদের বাছাই করে এনে ভর্তি করা হয় বুয়েটে। বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা উন্নত দেশগুলোয় কাজ করছেন সম্মানের সঙ্গে। বুয়েট নাম শুনলেই বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তথাকথিত মেধাবী একদল তরুণ তাদের সহপাঠীকে নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন করে? সেই ক্যাম্পাসে কী করে একদল ছাত্র একজন ছাত্রকে ডেকে মারতে মারতে মেরেই ফেলে? কোনো শব্দ হলো না। কেউ জানল না? কেউ প্রতিবাদ করল না? কেউ রিপোর্ট করল না?
হয়তো পরিস্থিতি এক দিনে এত খারাপ হয়নি। দিনের পর দিন রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কখনো রাজনীতির নামে, কখনো র্যাগিংয়ের নামে।
ব্যান স্টুডেন্ট পলিটিকস, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করো—এই স্লোগানের মধ্যে নীরবে একসময় প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসি। আমরা যার যার ঘরে ফিরে যাব। কুষ্টিয়ায় তখন কবরের মাটিতে শুয়ে আছেন ইলেকট্রিক্যালের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র আবরার। আবরার আর কোনো দিন মায়ের কাছে ফিরে যাবেন না। শিক্ষিকা মা, চাকুরে বাবার কত আদরের সন্তান আবরার। বুয়েটে যেদিন তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন, ভর্তি হয়েছিলেন, তখন কত গর্বে বুক ভরে উঠেছিল মা–বাবার। এলাকাবাসীও নিশ্চয়ই তাদের ছেলেকে নিয়ে গৌরব বোধ করেছে! এখন?
আবরারের মাকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব? কখন বলতে পারব, আর কোনো আবরারকে এই নিষ্ঠুর রাজনীতির শিকার হতে হবে না?