মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের শুরু ও শেষের আসল ঠিকানা। জন্ম হয়েছে এখানে, মরতেও চাই এখানেই। বাংলাদেশ আমাদের মা। আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের প্রাণ। যে কোন মূল্যে আমরা বাঁচিয়ে রাখব আমাদের এই মাতূভূমিকে। যেমনভাবে আমরা নিজেদের বিসর্জন দিয়ে, ইজ্জ্বত দিয়ে, জন্ম দিয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম এই দেশটির।
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০ এর ঘরে প্রায়। এই সময়ে আমরা অনেক বিপদে আপদে পড়েছি। পৃথীবির ইতিহাস ভঙ্গ করে আমরা যেমন সবচেয়ে কম সময়ে মাত্র ৯মাসে মুক্তির সংগ্রাম করে দেশ অর্জন করেছি ঠিক তেমনি আমাদের দেশের কতিপয় বিপদগামী নাগরিকের দ্বারা বিশ্বের ইতিহাস ভঙ্গও করেছি। মুক্তি সংগ্রামের মতই আমাদের কতিপয় খুনী নাগরিকের হাতে দুই জন রাষ্ট্র প্রধান খুন হয়েছেন ক্ষমতাসীন অবস্থায়। এই ইতিহাসও কম সময়ে সংঘটিত বিশ্বের ন্যাক্কার জনক ঘটনার মধ্যে অন্যতম। আমরা বাংলাদেশী। দেশ স্বাধীন করার পর ১০ বছরের মাথায় আমরা যে কলংকজনক নজির স্থাপন করেছি তা বিশ্ব ইতহাসকে পিছিয়ে দিয়েছে। তাই বলা যায়, আমরা যেমন সাহসী জাতি তেমনি কতিপয় লোকের ঘৃন্যতম কাজের জন্য ঘৃনিতও বটে। সুতরাং কম সময়ে আমরা জয়ীও হতে পারি আবার নিজেদের গায়ে কলংকও লাগাতে পারি। প্রথমটা গৌরবের। দ্বিতীয়টা ঘৃনার। তাই আমরা যেমন সাহসী তেমনী ভয়ঙ্করও বটে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সময় আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছি, তা আমরাই জানি। স্বাধীন জাতি হিসেবে চলার পথে আমরা বার বার বাঁধার সম্মুখিন হয়েছি। হোঁচট খেয়েছি অসংখ্যবার। আমাদের বাংলাদেশ সংবিধানচ্যুত হয়েছে একাধিকবার। বলা যায় আমরা অনেকটা সময়ই অসাংবিধানিক পথে হেঁটেছি। বাংলাদেশে যত গুলি সরকার এই দীর্ঘ সময়ে দেশ পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটি সরকারের ক্ষমতায় আসা নিয়ে পারস্পরিক বিতর্ক রয়েই গেছে। তাহলে সহজেই প্রশ্ন এসে যায়, কোন সরকার যদি অন্যায় পথে ক্ষমতায় আসে, তখন ওই সরকার বা সকরারগুলো কি করে জনগনের ও দেশের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা বা সংরক্ষন করবে।
ইতিহাস পর্যালোচনা ও বিশ্লেষন করলে সহজেই অনুমেয় যে, দেশ পরিচালনায় শাসন, অপশাসন বা দুঃশাসনের মধ্যে কি আছে কি নেই তা থেকে বেশী পিঁড়াদায়ক হল দেশের অভ্যন্তরে আমরা নীতি নৈতিকতার দিক থেকে কেমন আছি।
বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস শুরু হয় ছাত্রআন্দোলন থেকেই। আজ যারা দেশ পরিচালনা করছেন বা করেছেন তাদের অধিকাংশই ছাত্র রাজনীতি থেকে আসা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল বীরযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন তাদের অনেকেই ছাত্র রাজনীতি থেকে আসা। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি খারাপ কোন কাজ, এটা সঠিক নয়, আমরা সার্বিকভাবে নীতি ও নৈতিকতার বিপদ সীমানা অতিক্রম করছি বলেই ক্ষমতার লোভে আমরা কখনো কখনো মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, তাই ছাত্ররাও বিপদগামী হয়। যে ছাত্ররা দেশের জন্য, গনতন্ত্রের জন্য রাজপথে শহীদ হয়েছেন সেই ছাত্ররাই এখন ক্ষমতার লোভে ভাই হয়ে ভাইকে খুন করছেন নৃশংসভাবে। ছাত্র হয়েও শিক্ষালয় পরিচালনায় তারা খবরদারী করছেন। ক্ষমতায় থাকা, ক্ষমতায় আসা ও যাওয়ার মিশনে অপরাধ সংঘটনের কাজেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ছাত্ররা। হোষ্টেলে পাতলা ডাল ও রুটি খেয়ে যে ছাত্ররা লেখা পড়া করত, তারা এখন লাখ টাকা ভাড়ার বাসায় থেকে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। যে ছাত্ররা হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠে কোন গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিতে গিয়ে বই বুকে রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন, সেই ছাত্ররা এখন কোটি টাকার দামী গাড়িতে চড়ে শীতাতপের মধ্যে ঘুমায়। ছাত্রদের কষ্টকর জীবন ইতিহাস যখন বিলাসী হয়ে গেছে, ঠিক তখনই ছাত্ররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া শেষ করার আগেই তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন যা তাদের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে যাচ্ছে। এটা বিপদজনক বটে।
কারণ ছোট শিশুর হাতে চাকু দিলে যা হয় তাই হচ্ছে এখন। ফলে ছাত্রদের মধ্যে মেধাবী হওয়ার প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অপরাধী হওয়ার প্রতিযোগিতাও চলছে পাল্লা দিয়ে। এই অবক্ষয়কে টেনে না ধরলে আমরা ভয়াবহ বিপদে পড়ব, আবরার হত্যাকান্ডের মত পৈশাচিক হত্যাকান্ডের পরও আর না বুঝার কথা নয়।
ফলে প্রতিনিয়ত আমরা নতুন নতুন অপরাধের সাথে পরিচয় হই। প্রতিনিয়ত সংঘটিত নতুন ধরণের অপরাধগুলো আমাদের নৈতিকতাকে অবরুদ্ধ করছে। ফলে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আপদের সম্মুখিন হচ্ছি। এই আপদগুলো বিপদকে আহবান করে বড় ধরণের ক্ষয় ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।
আমাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি বলছে, উদ্দেশ্য যাই হউক, বর্তমান সরকার দূনীতি প্রতিরোধে যে অভিযান করছে, তা অতীতের সকল দলীয় সরকারের ভাল কাজকে অতিক্রম করেছে এটা সত্য। ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরণে দূনীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে নিজ দলের লোকজনকে আইনের আওতায় আনা নিঃসন্দেহে একটি ঝুঁকিপূর্ন কাজ। এই কাজের সাথে সাথে বাংলাদেশ ও ভারতে মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলো নিয়েও নানা ধরণের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে বলে বিতর্ক চলছে। এই নিয়ে সারাদেশে আলোচনা সমালোচনা বহমান।
এই অবস্থায় পৈশাচিক কায়দায় সংঘটিত আবরার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার সীমানা ও গন্তব্য জানাও কঠিন হচ্ছে। বিচারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে আমরা যদি নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রন করতে না পারি তবে ঘরের মধ্যে আগুন লাগলে ঘর হারানোর সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই যতদ্রুত সম্ভব আগুন নেভানো উচিত। না হয় ঘর হারা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে যা আমাদের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলবে।