ঢাকা: যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেওয়ার পর এবার গ্রেপ্তার হলেন সংগঠনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। তাঁর সঙ্গে আরো গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান। গতকাল রবিবার ভোরে কুমিল্লা থেকে ধরার পর সম্রাটের অফিস ও বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। বেসরকারি টেলিভিশনগুলো ওই অভিযানের খবর সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযানের পরবর্তী লক্ষ্য কে তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
এদিকে গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও এনামুল হক আরমানকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংগঠনটির শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক ও মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম মিজু কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক কারবার, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের অনেকেই এখন দেশে ও দেশের বাইরে নিরাপদ অবস্থান নিয়েছেন। ওই সব নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। কেউ কেউ বড় নেতাদের কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিপদের কোনো আশঙ্কা আছে কি না। এখন তাঁরা কী করবেন। ঢাকার বাইরেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলবে কি না। আতঙ্কিত ওই নেতাদের কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছেন না কেউই। বরং তাঁদের কণ্ঠেও উদ্বেগ ও হতাশার সুর।
তবে চলমান শুদ্ধি অভিযানে স্বস্তিবোধ করছেন ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নিষ্ঠাবান ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর আসন্ন সম্মেলনগুলোতে নেতৃত্ব থেকে ছিটতে পড়তে পারেন বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক বিতর্কিত নেতা। আর তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী নেতারা। বিভিন্ন সময় পদবঞ্চিত ওই নেতারা মনে করছেন, শুদ্ধি অভিযানের ফলে তাঁদের জন্য দলীয় বিভিন্ন কমিটিতে স্থান পাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, আতঙ্কিত নেতাদের তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্য ও অভিযান সম্পর্কে কঠোর অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেরাও বলছেন, এখানে দলের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতারই বা মন্ত্রী-এমপিদের কিছু করার নেই। বিষয়টি সরাসরি দেখভাল করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনাও করেননি।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর বেশ কিছু নেতাকর্মীর অপরাধের তথ্য-প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। সম্প্রতি গণভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সামনে এসংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদন পড়েও শোনান তিনি। এর পর আরেকটি সভায় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাকে পদ ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যুবলীগ নেতা সম্রাটের তীব্র সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর কয়েক দিন পরই মতিঝিলপাড়ায় সম্রাটের ক্যাসিনো সাম্রাজ্যে অভিযান চালায় র্যাব।
চলমান অভিযানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হবে। তার আগে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা ও উপজেলাগুলোর সম্মেলন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলন শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় একদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান, অন্যদিকে সম্মেলনে পদ হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেকেই।
নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান অভিযান সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দলের ও সহযোগী সংগঠনের কেউ কেউ দৈত্য হয়ে গেছেন। রাজধানীসহ সারা দেশে কিছু নেতার শুধু উত্থানই হয়েছে, পতন হয়নি। তাঁরা টাকা দিয়ে দলের সব স্তরে এমনভাবে জাল ফেলেছেন, এখনই রাশ টেনে না ধরলে দল বিপদে পড়বে। এসব নেতাকে ছেঁটে ফেললে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। হয়তো কিছু নেতার ব্যক্তিগত ক্ষতি হবে।
গত শুক্রবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, শুধু ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতারাই নজরদারিতে আছেন তা নয়, মূল দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, যাঁরা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। কোনো ধরনের অপকর্মে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।