ঢাকা: ২০০৬ সালের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধমের স্বাধীনতা সরাসরি খর্ব করেছে। এই আইনী খড়গের কারণে গণমাধ্যম কর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। একই সঙ্গে অধিকাংশ সাংবাদিকেরা সরাসরি রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করার কারণে গণমাধ্যম মালিক, সম্পাদক ও সাবাদিকেরা নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থানকে পক্ষভূক্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। সাংবাদিকতা পেশার রাজনীতিকরণ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রন আইনের ফলে গুরুতর ও স্পর্শকাতর অপরাধগুলো আঁড়াল হতে সহায়ক হয়ে থাকতে পারে।
সম্প্রতি ক্যাসিনো আবিস্কার হওয়ার পর সমাজে নানা ধরণের প্রশ্ন আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অপরাধ কি ভাবে আইনের চোখ ফাঁকি দিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্যাসিনো ব্যবসার নেপথ্যে কারা দায়ী, তা নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করছে। সরকার বলছে, পিছনের সরকারের আমলে এই ক্যাসিনো ব্যবসা চালু হয়েছে। সরকারী দল আরো বলছে, আজ যারা ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে ধরা পড়ছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই অন্য রাজনৈতিক দল থেকে অনুপ্রবেশ করেছেন। আর অভিযুক্তরা বলছেন, তাদের আমলে ক্যাসিনো চালু হয়নি। একই সঙ্গে যারা তাদের দল থেকে সরকারী দলে চলে গেছেন, তাদের বিষয়ে স্পষ্ট কোন ব্যাখাও দেননি তারা। এই পারস্পরিক দোষারোপ চলমান থাকলেও যুগের পর যুগ এই ক্যাসিনো ব্যবসা চলে আসছে এটাই সত্য ও বাস্তব। তবে মাঝ মাঝে গণমাধ্যমে এই ধরণের সংবাদ আসেনি তা নয়, এসেছেও।
বর্তমানে ক্যাসিনো ব্যবসার জন্য আইন শৃঙ্খল বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহল থেকে গণমাধ্যমকেও দোষারোপ করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, গণমাধ্যম কেন এতদিন ক্যাসিনো ব্যবসার অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন করতে পারল না। কিন্তু এই অভিযোগটিও স্পষ্ট যে, থানা এলাকায় একাধিক ক্লাবে ক্যাসিনো থাকলেও পুলিশ কেন দেখল না। অবশ্য পুলিশ বলছে, তারা এ গুলো দেখেনি। গনমাধ্যম বলছে, মাঝে মাঝে তারা এই সংক্রান্ত খবরও দিয়েছে।
অতিসম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৮ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ক্যাসিনো ব্যবসার পৃষ্টপোষকতা দেয়ার অভিযোগেই তাদের রদবদল করা হয়ে থাকতে পারে। পাশাপাশি নেপালী জুয়াড়িদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তার অপরাধে কয়েক পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক সিনিয়র সাংবাদিকের ছবি সহ নানা ধরণের খবর আসছে যে, তারাও ক্যাসিনো ব্যবসার দ্বারা লাভবান। তবে এই বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযোগ আসেনি।
তথ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষনে দেখা যায়, ২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত গণমাধ্যম যে কোন বিষয়ে ভাল রিপোর্টিং করতে পেরেছে। ২০০৬ সালে তৎকালিন সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ নামে আইনটি করেছে। এরপর ২০১৮ সালে সরকার তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ সালের আদলে কিছু কিছু ধারা সংযোজন ও বিয়োজন করে কঠিন ধারা সংযুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাশ করে। এই আইনে অসংখ্য সাংবাদিক কারাগারে গেছেন ও মামলায় ভুগছেন। যে কোন বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গেলে সংবাদকর্মীকে ভয় পেতে হচ্ছে, এই কারণে যে, ডিজিটাল আইনে মামলা হলেই গ্রেফতার হতে হবে।
ইতোমধ্যে এই আইনে অনেক সাংবাদিককে আটকের পরও মামলা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে এই আইনে মামলা হওয়ার সাথে সাথে গ্রেফতার করার বিষয়টি ষ্পষ্ট হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সহজেই সাংবাদিককে গ্রেফতার করতে পারছেন। এমনো দেখা গেছে, মামলায় সাংবাদিক গ্রেফতার হওয়ার পর প্রমান হয়েছে, তার খবর সঠিক ছিল। পরে মামলার চূড়ান্ত রিপোর্টও দেয়া হয়েছে। তবে ভুল মামলায় সাংবাদিক গ্রেফতার আতঙ্কের মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে দেখানো ভয়, বস্তুনিষ্ঠু সাংবাদিকতা বাঁধার মুখে পড়ে গেছে। ফলে ক্যাসিনোর মত গুরুতর অপরাধগুলো আইনের দৃষ্টির বাইরে গিয়ে মিডিয়ারও দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে সাংবাদিকদের উপর আইনী খড়গের কারণে।
পরিশেষে বলা যায়, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ব। এইস্তম্বটি থাকবে স্বাধীন। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ বলে গণমাধ্যম রাষ্ট্র জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময় স্বাধীনভাবে সক্রিয় থাকবে। একই সঙ্গে সংবিধানের প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষনে সরকারকে সব সময় সতর্ক থাকতে চাপে রাখবে গণমাধ্যম। কিন্তু গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রনেই বিশেষ আইন বলবৎ থাকায় গণমাধ্যম নিজেদেরই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, ফলে রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার সংরক্ষেনে কাজও করতে পারছে না।
তাই রাষ্ট্রের সকল অঙ্গকে স্বাধীনভাবে সক্রিয় রাখলে ক্যাসিনোর মত গুরুতর অপরাধই শুধু নয়, যে কোন অপরাধ ধামাচাপা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। তাই সরকারের উচিত গনতান্ত্রিক উন্নত রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ করে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সকল বাঁধা দূর করা। আর এই সমস্যা দূর হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিলেও গণমাধ্যমের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোন অপরাধ বড় হতে পারবে না। আর এই সমস্যা থাকলে ক্যাসিনোর মত গুরুতর অপরাধের পাশাপাশি নতুন নতুন অপরাধ তৈরী হতে পারে যা আবিস্কার হবে না গণমাধ্যম বাঁধা থাকার কারণে।
লেখক
প্রধান সম্পাদক
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম