চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়: লাগামছাড়া চলছে দেশে উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয়। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ ও প্রস্তাব করছে ইচ্ছেমতো। ২০ থেকে ৫০ টাকা দামের একটি স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। ২ হাজার টাকা দামের পিলোর (বালিশ) দর ২৭ হাজার ৭২০ টাকা আর কভার ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। ওই কভারের দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এ ছাড়া ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা; যার বাজারদর সরেজমিন যাচাই করে জানা গেছে মান ভেদে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচ বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে এই প্রকল্পের খরচের হিসাব নিয়ে অসন্তোষ ও চরমভাবে আপত্তি জানানো হয়। প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। একনেকে তা এখনো অনুমোদন হয়নি। অনুমোদন পেলে তিন বছরে এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কাজ সমাপ্ত হবে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এই প্রকল্পটি বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে। আর্থসামজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এই প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির বৈঠক হয়।
ব্যয় পর্যালোচনা ও সরেজমিন দর যাচাই করে দেখা যায়, বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য যে দাম প্রস্তাব করা হয়েছে তা অতিরঞ্জিত ও অস্বাভাবিক। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এই ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের জন্য ১২টি চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম অতিরঞ্জিত ও যথেচ্ছভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে। সরেজমিন তোপখানা রোডস্থ সার্জিক্যাল মার্কেটে এসব পণ্যমূল্য যাচাই করে দেখা যায় প্রকৃত মূল্যের সাথে প্রস্তাবিত মূল্যের কোনো সম্পর্কই নেই। বিক্রেতারা এসব প্রস্তাবিত পণ্য মূল্য শুনে হতবাক। স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভস প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা; যা ভ্যাট, ট্যাক্সসহ বাজারমূল্য প্রতিটির ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। ৫ এমএলের টেস্ট টিউব গ্লাস মেডের দাম ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার টাকা। বাজারমূল্য হলো ১৫ থেকে ৫০ টাকা। ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির দাম ৮৪ হাজার টাকা, বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। পিলো (অ্যাজ পার স্পেসিফিকেশন) ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। বর্তমান বাজারমূল্য সাড়ে ৭০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। আর পিলো কভার ২৮ হাজার টাকা। বাজারদর ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা বলে বিক্রেতারা বলছেন। তিন পিন বা রাউন্ড প্লাগের মাল্টিপ্লাগ উইথ এক্সটেনশন কর্ডের দাম ৬ হাজার ৩০০ টাকা, বাজারমূল্য ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
ক্রম চিকিৎসা সরঞ্জামাদির নাম প্রতিটি পণ্যের প্রস্তাবিত একক মূল্য সম্ভাব্য বাজার মূল্য (সরবরাহকারীর লাভ, ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ) ১। স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভস ৩৫,০০০.০০ টাকা ২০.০০-৫০,০০০ টাকা ২। টেস্ট টিউব-গ্লাস মেও, সাইজ ৫ এমএল ৫৬,০০০,০০ টাকা ১৫.০০, ৫০০০ টাকা ৩। মাল্টিপ্লাগ উইথ এক্সটেনশন কর্ড, ৩ পিন ফ্লাট/ রাউন্ড প্লাগ ৬,৩০০.০০ টাকা ২৫০.০০- ৫০০.০০ টাকা ৪। রাবার কথ, ৫র্৪র্ (উইডথ (ইয়ার্ডস) ১০,০০০.০০ টাকা ৫০০.০০ ৭০০.০০ টাকা ৫। রেক্সিন, ৫র্৪র্ উইডথ (ইয়ার্ডস) ৮৪,০০০.০০ টাকা ৩০০.০০- ৫০০,০০ টাকা ৬। কটন টাওয়েল, সাইজ ২র্২র্ * ৩৬র্ র্ ৫,৮৮০.০০ টাকা ২৫০.০০. ১০০০.০০ টাকা ৭। হোয়াইট গাউন, লেন্থ ৫র্৪র্ ৪৯,০০০.০০ টাকা ১০০.০০-২০০.০০ টাকা ৮। ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক ৮৪,০০০.০০ টাকা ১০০০.০০- ২০০০.০০ টাকা ৯। ডিসপোজেবল সু কভার ১৭,৫০০.০০ টাকা ২০.০০, ৫০০০ টাকা ১০। পিলো, অ্যাজ পার স্পেসিফিকেশন ২৭,৭২০.০০ টাকা ৭৫০.০০. ২০০০.০০ টাকা ১১। পিলো কভার, অ্যাজ পার স্পেসিফিকেশন ২৮,০০০.০০ টাকা ৫০০.০০. ১৫০০,০০ টাকা
সরেজমিন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি সাদা গাউনের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা যার বর্তমান বাজারদর সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। প্রকল্পে ২২ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি আকারের কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য হলো মানভেদে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি রেক্সিনের দাম ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারদর ৩ শ’ থেকে ৫ শ’ টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের রাবার ক্লথ ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বাজারে গিয়ে দাম জানা গেছে ৫ শ’ থেকে ৭ শ’ টাকা।
প্রকল্পের কিছু কিছু যন্ত্রপাতির ভিন্ন ভিন্ন দাম প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্যাথলোজি বিভাগের জন্য চারটি স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের দাম ডিপিপিতে (পৃষ্ঠা-৬৪) প্রতিটি দেড় লাখ টাকা ধরা হয়েছে। চারটির দাম ৬ লাখ টাকা। ল্যাব. মেডিসিন বিভাগের জন্য চারটি স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ (ডিপিপি-পৃ. ৭০) ৩০ কোটি টাকা। এখানে প্রতিটির দাম সাড়ে ৭ কোটি টাকা। ১১৫ পৃষ্ঠায় এ মেশিনের দাম ৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের এই ধরনের অত্যাধুনিক দামি যন্ত্রপাতি চারটি করে ক্রয় করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। এই দুই বিভাগের চিকিৎসাসরঞ্জামের তালিকা ১ থেকে ৫২ ক্রমিক নম্বর পর্যালোচনায় দেখা যায়, হুবহু একই ধরনের চিকিৎসাসরঞ্জামের দামে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে।
জানা গেছে, যেখানে অধ্যাপকদের জন্য ১২০টি ইউনিট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের জন্য ৪০টি ইউনিট, সহযোগী অধ্যাপকদের জন্য ২৪০টি ইউনিট, সহকারী অধ্যাপকদের জন্য ৩ শ’টি ইউনিট, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য ৭০টি ইউনিট, সাব-অ্যাসিসট্যান্টদের জন্য ২৫০টি ইউনিট, সেখানে প্রতিটি আইটেম প্রায় ১০৫০টি করে কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। রিসার্চ সেলের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আবার অন্য রিসার্চ ল্যাবের জন্য যন্ত্রপাতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। আসবাবপত্র ও ফার্নিচারের ক্ষেত্রেও প্রাক্কলিত দর একেক জায়গায় একেক রকম ধরা হয়েছে। হাস্যকর বিষয় হলো, ২০তলা ভবনের জন্য ধরা হয়েছে ১০তলা ফাউন্ডেশন। ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক হলেও এই প্রকল্পে তা করা হয়নি। তাই অতিরঞ্জিত মূল্য ধরা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, একটি বিভাগের ১২টি আইটেমেই প্রস্তাবিত মূল্যের সাথে বাজারমূল্যের পার্থক্য আকাশছোঁয়া। এই প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত সব যন্ত্রপাতি বা চিকিৎসাসরঞ্জাম ক্রয় পর্যালোচনা করলে এই অসামঞ্জস্য আরো বেশি হবে। এই ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাক্কলন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডিপিপিতে ১২৭ থেকে ১৪৩ পৃষ্ঠায় বিভিন্ন দফতরের জন্য প্রায় ১০৫০টি ওয়াটার ফিল্টার, ১০৫০টি রিভার্স ওসমোসিস, প্রায় ১০৫০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং ১০৫০টি ল্যাপটপ, ১০৫০টি কালার প্রিন্টার ও ১০৫০টি সাদা-কালো প্রিন্টার ক্রয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ওয়াটার ফিল্টার থাকলে রিভার্স ওসমোসিস, ডেস্কটপ থাকলে ল্যাপটপ এবং কালার প্রিন্টার থাকলে সাদা-কালো প্রিন্টার এত বিপুল সংখ্যায় ক্রয়ের যৌক্তিকতা নেই। একই রকম চিত্র গাইনি বিভাগের জন্য সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও।
এই ব্যয় প্রাক্কলনের ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা নিরূপণের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, প্রকল্প রিজেক্ট করা হয়েছে। অনুমোদন পায়নি পিইসিতে। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ব্যয় প্রাক্কলন অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অতিরঞ্জিত। তিনি বলেন, গত ৩০ মে অনুষ্ঠিত যৌক্তিকতা নিরূপণ কমিটির সভায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপক, দু’জন সহযোগী অধ্যাপক, ডিপিপি প্রণয়নকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর সাথে ওই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অফিস সহায়কের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। সরকারি দফতরের ব্যয় প্রাক্কলনের মতো একটি সংবেদনশীল কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, যারা এই ডিপিপিতে ব্যয় প্রাক্কলন করেছেন তারা দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞ।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ডিপিপি প্রস্তুতে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কারা কারা জড়িত ছিল তা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ খরচের জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন নতুন খাত। প্রকল্প মূল্যায়ন কোনোভাবে ম্যানেজও করা হচ্ছে। ফলে ব্যয়ের খাতগুলো নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন উঠছে না। কোনো না কোনোভাবে তা সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ব্যয় অনুমোদনও নেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা আছে সেগুলোর তোয়াক্কা করছে না বেশির ভাগ বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমদ এ ব্যাপারে বলেন, বিচারহীনতা থাকলে এমন অবস্থা চলতেই থাকবে। তিনি বলেন, এই ধরনের প্রস্তাবনা এলে তা ফেরত না পাঠিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের উচিত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। এভাবে ফেরত পাঠানো কোনো সমাধান নয়। অনেক ঘটনাই তো ঘটছে। শাস্তি না হওয়ার কারণে এসবের মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। শাস্তি দৃশ্যমান হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, উন্নয়নের নামে এভাবে জনগণের সম্পদ নষ্ট ও আত্মসাৎ করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে কেউ কেউ ধনী হচ্ছে। অঢেল সম্পদ বানাচ্ছে।