যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে গত দুদিন ধরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কোনো যোগাযোগ নেই। এ কারণে তাদের ধারণা সম্রাট এখন গোয়েন্দা হেফাজতে রয়েছেন। আটকের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে সম্রাটকে আটক করে কোথায় রাখা হয়েছে সে বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সংস্থাই এখনও পর্যন্ত খোলাসা করে কিছু বলছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্রাট তাদের জালের মধ্যেই আছেন।’
তবে সম্রাটের আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন কিনা শিগগিরই জানা যাবে। আপনারা দেখবেন, খুব শিগগিরই দেখবেন। অপেক্ষা করুন, যা ঘটে দেখবেন।’
কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ গতকাল শনিবার জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন, ‘তার বিষয়ে (সম্রাট) আমার কাছে কোনো তথ্যই নাই। পত্রিকা পড়ে তার সম্পর্কে জানছি। চলমান অভিযানের পর থেকেই তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।’
তবে গতকাল যুবলীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে সম্রাটের বিষয়ে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে দুজন যুবলীগ নেতা বলেছেন, সম্রাট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই আছেন। সময় ও সুযোগ মত তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।’ ওই দুজন যুবলীগ নেতার বরাত দিয়ে জানতে চাইলে এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা যেটা বলেছেন সেটা মিথ্যা নয়, চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের শুরু থেকেই সম্রাটের ওপর কড়া নজরদারি ছিল। খালেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই সম্রাট গোয়েন্দা জালের মধ্যেই রয়েছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’
গোয়েন্দাদের সূত্র জানিয়েছে, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে সম্রাটসহ ক্যাসিনো কারবারে আটক ও গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
এছাড়াও গতকাল সম্রাটের আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগের একাধিক নেতা প্রায় একই বক্তব্য দেন। তারা বলেছেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থেকেই সম্রাট গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছিলেন। খালেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর সম্রাট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও ফেনী সীমান্ত দিয়ে বিদেশে পালানোরও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ করেও কোন সুবিধা করতে পারেননি। এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারেন দেশ থেকে পালানোর আর কোনো সুযোগ নেই, তখন ব্যাপক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।
এরপর বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর কাকরাইলে ঈশা খাঁ হোটেলের বিপরীতে ‘ভুঁইয়া ম্যানশনে’ নিজ কার্যালয়ে অবস্থান নেন। সেখানে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সারারাত থাকেন। এরপর অবস্থা নিজের অনুকুলে না থাকায় সেখান থেকে সটকে পড়েন সম্রাট। চলে যান অনেকটা আত্মগোপনে।
যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, খালেদ গ্রেপ্তারের পরই ভড়কে যান সম্রাট। গ্রেপ্তার এড়াতে শুরু করেন নানা মহলে লবিং। দলীয় হাইকমান্ডকে দফায় দফায় বোঝানোর চেষ্টা করেন দলের প্রতি তার অবদানের কথা। গত রবিবার তিনি বনানী ডিওএইচএস এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করেন। সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো যা বলেন: গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে সম্রাটের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘যে যেই ধরনের অপরাধই করুক না কেন তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। এ জন্য আমরা তথ্যভিত্তিক অভিযান চালাচ্ছি। আপনারাও দেখছেন। অপরাধ ঘটছে বা যারা অপরাধ ঘটাচ্ছে— এমন খবর যখনই পাব তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এটা কোনো শুদ্ধি অভিযান না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যা করার প্রয়োজন তাই আমরা করছি।’ সম্রাটকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা অনেক কিছু বলছেন, আমরা যেটা বলছি ‘সম্রাট’ হোক যেই হোক অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। আমি এটা এখনও বলছি, সম্রাট বলে কথা না, যে কেউ আইনের আওতায় আসবে।’
ক্যাসিনোর অভিযান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের আমরা সবসময় সঠিক তথ্যটাই দিয়ে থাকি। চলমান যে অভিযান, এটাকে আমি অভিযান বলব না, এটা সবসময় হয়ে থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে এগিয়ে গেছে তার মূল কারণ হলো, সামনে কি আসবে সেটা নিয়ে তিনি চিন্তা করেন।’
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান র্যাবই পরিচালনা করবে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু অভিযানটি র্যাব শুরু করেছে, তাই তারাই অভিযান চালাবে। তবে অভিযানে অযথা কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হবে।’
সম্রাটকে আগলে রাখা নেতাকর্মী কমে গিয়েছিল
গত কয়েকদিনে কাকরাইলে সম্রাটের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শুরুতে যেভাবে নেতাকর্মীরা সম্রাটকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল সেভাবে আর নেতাকর্মী নেই তার অফিসের সামনে। তিনি ধরা পড়ার আগের দিন পর্যন্ত তার কার্যালয়ে সর্বোচ্চ ২০ জনকে দেখা যায়। এসব নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছয়দিন কার্যালয়ে থেকে স মাট অফিস থেকে বের হয়ে যান। এরপর আর তিনি অফিসে আসেননি। আর এ কারণেই অফিসে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কমেছে। অফিসে না আসায় নেতাকর্মীদের কেউ কেউ তাঁকে তার বাসাতেও খুঁজছিলেন। বাসায়ও তাকে পাননি তারা।
কাকরাইলে সম্রাটের কার্যালয়ে গিয়ে আরো দেখা যায়, ভবনটির প্রধান ফটকের কলাপসিবল গেটে তালা লাগানো। ভেতরে তিনজন দারোয়ান। তাদের সঙ্গে কথা বলে কেউ কেউ ভেতরে ঢুকছে। এ প্রতিবেদক স মাট তার কার্যালয়ে আছেন কিনা জানতে চাইলে তারা অনেকটা এক সুরে বলেন, ‘স্যার অসুস্থ, স্যারের মাও অসুস্থ। স্যার মাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছেন। এ কারণে মনে হয় অফিসে আসছেন না।’ তবে কোন হাসপাতালে সম্রাটের মা আছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, এটা তারা জানেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই আলোচনায় আসে সম্রাট ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার নাম। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চারদিনের মাথায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর সম্রাট-খালেদ নিয়ন্ত্রিত ক্যাসিনোগুলোতে অভিযান শুরু করে র্যাব। ওই দিনই গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সম্রাটের এক সময়ের ঘনিষ্ট সহযোগী খালেদকে।
এরপর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন সম্রাট। ক্যাসিনো ‘সম্রাটের’ বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি পরিচালনার অভিযোগও ওঠে। তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ। গত রবিবার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত আদেশ দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়। সেইসঙ্গে তার ব্যাংক হিসাবও তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক।