ঢাকা: রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার বাবার একটি টিনশেড বাড়ি ছিল ওয়ারীর মৈশুন্দি এলাকায়। তাঁরা তিন বছর আগে গেণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের কমিটিতে জায়গা করে নেন। এরপর যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাত ধরে ক্যাসিনো কারবারে যুক্ত হন তাঁরা। দুজনই খালেদের ডানহাত হিসেবে পরিচিত। এখন রাজধানীতে তাঁদের ১৫টির বেশি বাড়ি রয়েছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটও। নগদ টাকা আর বাড়ি-ফ্ল্যাট মিলে দেড় শতাধিক কোটি টাকার মালিক এই দুই ভাই।
যুবলীগ নেতা খালেদের হয়ে দুই সহোদর এনু ও রুপন সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া ও ওয়ারী এলাকার অপরাধীচক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ জন্য তৈরি করেন ২৬ জনের বাহিনীও। এতে তাঁদের পরিবারেরই রয়েছে ১০-১২ জন। তাদের ভয়ে তটস্থ থাকত এলাকার লোকজন। চাঁদাবাজিসহ তাদের অন্যান্য অপকর্মের কথা জানলেও প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
সরেজমিন ঘুরে এবং র্যাব, স্থানীয় লোকজন, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এনামুল হক এনু গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁর ছোট ভাই রুপন ভূঁইয়া একই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বন্ধে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে প্রথমে র্যাব-৩-এর একটি দল সূত্রাপুর থানাধীন বানিয়ানগর এলাকার ৩১ নম্বর ছয়তলা বাড়িতে অভিযান চালায়। এটি এনু ও রুপনদের নিজেদের বাড়ি। ভবনটির দোতলায় এনুর ফ্ল্যাটে থাকা দুটি ভল্ট ও পাঁচতলায় রুপনের ফ্ল্যাটে থাকা একটি ভল্ট থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের আট কেজি স্বর্ণালংকার ও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। র্যাব খবর পায় আরো টাকা ও অস্ত্র আছে নারিন্দার দুটি বাড়িতে। এরপর ৮২/১ লালমোহন স্ট্রিটের দোতলায় এনুর কর্মচারী আবুল কালাম ওরফে কালার নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকা ভল্ট থেকে দুই কোটি টাকা ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এরপর শরত্গুপ্ত রোডের ২১/১/এ নম্বর দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে একটি ভল্ট থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। এ বাড়ির মালিক এনুর বন্ধু হারুনুর রশীদ। তবে তাঁদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি র্যাব। পুরান ঢাকায় এনু ও রুপনদের ১৫টি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে র্যাব। বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও র্যাবের কাছে তথ্য আছে।
র্যাব-৩ সূত্র বলছে, ১৫টি বাড়ি ১০ কোটি টাকা করে হলে ১৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাঁদের ফ্ল্যাটও রয়েছে। পাওয়া গেছে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার। হিসাব করলে এনু ও রুপনের দেড় শ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে।
র্যাব-৩-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক এ এস এম সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘এ ঘটনায় ওয়ারী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরো মামলা দায়ের করা হবে।’
গতকাল বুধবার দুপুরে সূত্রাপুর থানাধীন দয়াগঞ্জ নতুন রাস্তার পাশে বানিয়ানগরের ৩১ নম্বর বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেছে, কলাপসিবল গেটে তালা লাগানো। কিন্তু বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়। এসেছেন আশপাশের বাড়ির কয়েকজন নারীও। তাঁদের একজন জানান, একসময় এনুর বাড়ির জায়গাটিতে কাসেমের রিকশার গ্যারেজ ছিল। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ তাঁরা দেখতে পান গ্যারেজটি ভেঙে এনুরা বহুতল বাড়ি নির্মাণ করছেন। জমিটি দখল করা হয়েছে, নাকি তাঁরা এনুর কাছে বিক্রি করেছেন সেটা বলতে পারেননি তিনি।
স্থানীয় লোকজন বলেছে, এনু ও রুপন গত তিন বছরে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁদের অবৈধ আয় দিয়ে বাড়ি বানানো ও ফ্ল্যাট কেনার নেশা ছিল।
দুপুর ১২টার দিকে দয়াগঞ্জ এলাকায় ৪০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন নেতাকর্মী আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁরা এনু ও রুপনের বিষয়ে আলোচনা করছেন। এ অভিযানের কারণে তাঁদের উত্ফুল্ল দেখা গেল। জানতে চাইলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই ভাই তিন বছর আগে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করে। এর আগে তাদের আমরা চিনতাম না। ওই সময় শুনি তারা দুই ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।’
স্থানীয় লোকজন জানায়, দয়াগঞ্জের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে আসতেন এনু ও রুপন। তাঁরা আসার সময় সঙ্গে ২০-২৫ জন থাকত। তাদের অনেকের কাছে থাকত আগ্নেয়াস্ত্র। এলাকার পুরনো নেতাদের তাঁরা সম্মান করার প্রয়োজনীয়তা মনে করতেন না।
স্থানীয় আওয়ামী ও যুবলীগ নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা নিজেরা জানলেও এনু ও রুপনের অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করতেন না। তবে এখন তাঁরা দুই ভাইকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
একই সময় গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠের কাছে ও দয়াগঞ্জ মোড়ের পাশের আওয়ামী লীগ কার্যালয় বন্ধ পাওয়া গেছে।
দুই ভাই খালেদের ডানহাত : স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালে তাঁরা জানতে পারেন এনু ও রুপন গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের কমিটিতে নেতা হিসেবে স্থান পেয়েছেন। এর আগে তাঁদের চিনতেন না। তবে তাঁদের বড় ভাই ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের নেতা রশীদুল হক ভূঁইয়াকে চিনতেন। তিনি এখন এই কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি।
এক যুবলীগ নেতা জানান, আওয়ামী লীগে যোগদানের পরপরই এনু ও রুপনকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের সঙ্গে মতিঝিল এলাকায় চলাফেরা করতে দেখেন। এর কিছুদিন পরই তাঁরা এলাকায় চাঁদাবাজিও শুরু করেন। যুক্ত হন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো কারাবারে। এরপর তাঁদের পরিবারের ভাই ও ভাতিজাদের মধ্যে ১০-১২ জন জড়িয়ে পড়েন ক্যাসিনো কারবার ও চাঁদাবাজিতে। প্রতিদিন তাঁরা লাখ লাখ টাকা কামাতে শুরু করেন। এভাবে তিন বছরে শতকোটি টাকার মালিক বনে যান।
ওই যুবলীগ নেতা জানান, তাঁরা শুনেছেন এনুদের পরিবারের ১৫-২০টি বাড়ি আছে। এর মধ্যে তাঁদের পরিবারের লোকজন তিনটি বাড়িতে থাকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এনু ও রুপনের বাবার নাম সিরাজ মিয়া। তিনি দুই বিয়ে করেন। দুই স্ত্রীর ঘরে তাঁরা ছয় ভাই। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এনু, রুপনসহ পাঁচ ভাইয়ের জন্ম। বড় ভাই রশীদুল হক ভূঁইয়ার হাত ধরেই এনু ও রুপন রাজনীতিতে নামেন। তবে একটি সূত্রের দাবি, তাঁরা একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।
৬৯৭ কেজি ওজনের ভল্ট : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টাকা ও স্বর্ণালংকার রাখার জন্য পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের একটি দোকান থেকে বিশাল একটি ভল্ট বানিয়ে নিয়েছিলেন এনু। সেই ভল্টটি উচ্চতায় চার ফুট। দৈর্ঘ্য ৪০ ইঞ্চি আর প্রস্থ ৩১ ইঞ্চি। লোহার এই ভল্টটির ওজন ৬৯৭ কেজি। এ ছাড়া আরো চারটি ভল্ট বানিয়ে নেওয়া হয় এই দোকান থেকে। সবচেয়ে বড় ভল্টটি এনুদের বানিয়ানগরের বাসার দ্বিতীয় তলায় ওঠানোর দিন ১০-১৫ জন লোক লেগেছিল। তখন এ খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। র্যাবের গোয়েন্দাদের কানেও যায় সেই খবর। পরে র্যাবের গোয়েন্দারা তথ্য তালাশে নামেন। তাঁরা খুঁজে পান ইংলিশ রোডের সেই দোকান, যেখান থেকে ভল্টগুলো বানিয়ে আনা হয়। ভল্টগুলো পৌঁছে দিয়েছিলেন যেসব ভ্যানচালক, তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতেই এনুর বাড়ির ঠিকানা পায় র্যাব।