ঢাকা: অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এবার সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বা নিধনের জন্য একই ওষুধ কিনতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন চেয়ে দক্ষিণ সিটি ৪০ শতাংশ বেশি খরচ করেছে। টিআইবি বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক কেনাসহ বার্ষিক পরিকল্পনায় অনিয়ম ছিল তাদের। দরপত্র পদ্ধতি, নথি ও দাখিলেও অনিয়ম দেখা গেছে। কীটনাশক কেনার আগে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষায় অনিয়ম ও সীমাবদ্ধতা ছিল। মশক নিধন কার্যক্রমেও অনিয়ম দুর্নীতি আছে।
আজ রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ঢাকা শহরের এডিস ‘মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে লিমিট এগ্রোপ্রোডাক্টের কাছ থেকে প্রতি লিটার কীটনাশক ৩৭৮ টাকায় সরাসরি কেনার কার্যাদেশ দেয়। একই প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) উন্মুক্ত দরপত্রে প্রতি লিটার কীটনাশক ২১৭ টাকায় দেয়ার প্রস্তাব করে। এ হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ক্ষতি হয়েছে প্রতি লিটারে ১৬১ টাকা। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ বেশি আর্থিক ক্ষতি করে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কীটনাশক কিনেছে।
গুণগত পদ্ধতিতে টিআইবি এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে দাবি করে সংস্থাটি জানায়, এটি করতে তারা এক মাস (২০শে আগস্ট থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর) সময় নিয়েছেন। জরুরি স্বাস্থ্য বিবেচনায় টিআইবি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
টিআইবি বলছে, প্রাক বর্ষা মৌসুমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ছিল ২১ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ছিল ২৬ শতাংশ। অথচ ২০ শতাংশের বেশি এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালেও দুই সিটির গড় ২০ শতাংশের বেশি ছিল। এটি ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে বেশি বলে তাদের অবহিত করেছিল আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় শুধু বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ছয় শতাধিক। রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য সংকলন করেছে। গুটি কয়েক হাসপাতালের খণ্ডিত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের হারের তুলনামূলক চিত্র দিয়ে পরিস্থিতির মাত্রা কম দেখানো হয়েছে।
টিআইইবি’র মতে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশনের এলাকাভিত্তিক বা আঞ্চলিক কোনো পরিকল্পনা ছিল না। দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল।
মাঠ পর্যায়ের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অপ্রয়োজনীয় ও লোক দেখানো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগের বিস্তারের ভয়াবহতা পরবর্তীতে স্বীকার করলেও কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হোল্ডিং করদাতাদের জন্য এরোসল ক্রয়, ডেঙ্গু মশার অ্যাপ তৈরি, গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য পরিষ্কার সড়কে লোক দেখানো ‘বর্জ্য পরিষ্কার’ এবং ফগিং করা। মশক নিধন কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে টিআইইবি বলছে, কীটনাশক ও ফগার মেশিনের জ্বালানি ব্যবহার না করে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়; লার্ভিসাইড ব্যবহার না করে ফেলে দেয়া হয়। ভবনের নিচে তলায় বা গ্যারেজে ফগিং করার জন্য টাকা নেয়া (৫০ থেকে ২০০ টাকা) হয়। ডেঙ্গু মৌসুম শেষ না হতেই মশক নিধন কার্যক্রমে শৈথিল্য লক্ষ্য করা যায়।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উত্তর সিটি কর্পোরেশন যে প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল ওই প্রতিষ্ঠান থেকেই দক্ষিণ সিটি কীটনাশক কিনে সরকারের ৪০ শতাংশ বেশি আর্থিক ক্ষতি করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকলেও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে যে জাতীয় কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা করার কথা, তা খুব প্রাথমিক অবস্থায় আছে। বিভিন্ন জায়গায় লোক দেখানো কাজ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষক মো. জুলকার নাইন এবং মো. মোস্তফা কামাল।