ঢাকা: দীর্ঘ ২৭ বছর পর ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হলো ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব। নয়া ইতিহাস গড়ে বিএনপির ভ্যানগার্ড খ্যাত সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফজলুর রহমান খোকন এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল হোসেন শ্যামল। জমজমাট লড়াইয়ে সভাপতি খোকন পেয়েছেন ১৮৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ পান ১৭৮ ভোট। আর সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী শ্যামল পেয়েছেন ১৩৯ ভোট। তার নিকতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকিরুল ইসলাম পান ৭৪ ভোট। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ছেলে খোকন ২০০০ সালে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ২০০২ সালে শেরপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে একই বিভাগে এইচএসসি পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৮ সালে অনার্স ও ২০১০ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। খোকন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রদলের দপ্তর বিষয়ক সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছাত্রদলের সদ্য বিদায়ী কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে খোকন বড়।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার ছেলে ইকবাল হোসেন শ্যামল ২০০৩ সালে রায়পুরা আর কে আর এম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০০৫ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ২০০৯ সালে অনার্স ও ২০১০ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে অধ্যয়নরত রয়েছেন শ্যামল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এদিকে, নির্বাচিত হওয়ার পর ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সফলে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন বলে জানান তারা। এ সময় ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, ছাত্রদলের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করা। আর তার মুক্তির মধ্য দিয়েই আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদলকে আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। তিনি বলেন, আপনারা জানেন, ডাকসু নির্বাচনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। আমরা ছাত্রদের অধিকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের কার্যাবলি সুনিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাব।
যেভাবে ভোট গ্রহণ হল: গত বুধবার দুপুরের পর থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হতে থাকে ছাত্রদলের কাউন্সিলর, প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকরা। বিকাল ৪টার পর থেকে বিএনপির অফিসের দ্বিতীয় তলায় সাবেক ছাত্র নেতাদের সঙ্গে স্কাইপে বৈঠক করেন লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তখন তৃতীয় তলায় কনফারেন্স কক্ষে অবস্থান করেন প্রার্থী ও কাউন্সিলররা। এরপর সন্ধ্যায় প্রার্থী ও কাউন্সিলরদের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের শাহজানপুরের বাসায় যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আর সেখানে ভোট হবে বলে অবগত করা হয়। কাউন্সিলর ও প্রার্থীরা কার্ড দেখিয়ে মির্জা আব্বাসের বাসার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে লন্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত হয়ে তারেক রহমান কাউন্সিলর ও প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। মোট ছয়টি বুথে ভোট গ্রহণ হয়। কোন রকম বিরতি ছাড়াই ভোট গ্রহণ চলে রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও প্রার্থীদের সঙ্গে আবার স্কাইপের মাধ্যমে কথা বলেন তারেক রহমান। এর পর প্রার্থীদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা করা হয়। গননা শেষে ভোর রাতে সাংবাদিকদের সামনে নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এ সময় ছাত্রদলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও সংগঠনটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল কবির খোকনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রদলের কাউন্সিলে নির্বাচন পরিচালনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন, সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক মিলন। তার সঙ্গে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন, সাবেক দুই সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও আজিজুল বারী হেলাল। সাবেক ছাত্রদল নেতা এবিএম মোশাররফ হোসেন, শফিউল বারী বাবু ও সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু পোলিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ষষ্ঠ কাউন্সিলে নয়জন সভাপতি প্রার্থী এবং ১৯ জন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীর মধ্য থেকে দুই পদে দুজনকে বেছে নিতে ভোট দেন ছাত্রদলের ১১৭টি সাংগঠনিক শাখার ৫৩৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪৮১ জন।
ছাত্রদলের শীর্ষনেতা নির্বাচনে ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম ভোট হল। ১৯৯২ এর কাউন্সিলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সভাপতি এবং সিলেটের গুম হওয়া বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে কয়েক মাস পরই কমিটিটি ভেঙে দেয়া হয়েছিলো।
ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটি গঠন হয়েছিল ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর। ওই কমিটিতে সভাপতি ছিলেন রাজীব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আকরামুল হাসান। শুরুতে ১৫৩ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘদিন পর এই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়, যাতে ৭৩৬ জনকে পদ দেয়া হয়েছিল। গত ৩রা জুন ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেয় বিএনপি। এরপর ৪৫ দিনের মধ্যে কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের সিদ্ধান্তের কথা জানায় দলটি।
১৪ই সেপ্টেম্বর কাউন্সিলের দিন ঠিক করে নানা প্রস্তুতি নেয়ার পর আকস্মিকভাবে ছাত্রদলের এক নেতার আবেদনে কাউন্সিলের উপর আদালত স্থগিতাদেশ দেন। ফলে, নির্ধারিত দিনে আর কাউন্সিল হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপে আদালত এই স্থগিতাদেশ দিয়েছে অভিযোগের পর বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, আইনিভাবে মোকাবেলা করেই ছাত্রদলের কাউন্সিল করবেন তারা।
বিএনপি নেতারা আইনজীবীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, কাউন্সিল করায় আইনগত কোনো বাধা নেই। এর পরপরই বুধবার বিকালে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে প্রার্থী ও কাউন্সিলরদের ডাকে ষষ্ঠ কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি।