ডেস্ক:ভারতের নয়াদিল্লির প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় গত মঙ্গলবার আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে দু’টি বিপরীতমুখী সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘ইউনাইটেড এগেনস্ট হেট’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনআরসি প্রক্রিয়ার আড়ালে থাকা অমানবিক দিক উন্মোচন করে দেশটির জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এদিকে মঙ্গলবার অপর একটি সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টে নাগরিকপঞ্জি সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলার মূল বাদীর পক্ষে আসাম পাবলিক ওয়ার্কস (এপিডব্লিউ) এনআরসির তালিকায় হাজার হাজার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর নাম ঢুকে পড়েছে অভিযোগ করেছে। তালিকাটি রি-ভেরিফিকেশনের দাবিতে এনআরসিতে ঢুকে পড়া অবৈধ বাংলাদেশির তথ্য যুক্ত করে বুধবার সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামাও পেশ করেছে এপিডব্লিউ। খবর যুগশঙ্খ-এর।
‘ইউনাইটেড এগেনস্ট হেট’-এর সংবাদ সম্মেলনে এনআরসির অমানবিক দিকের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর আসাম সফর করে তৈরি করা ‘ডেমোক্রেসি আন্ডার ডিটেনশন : হররস অব এনআরসি ফ্রম আসাম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সঞ্জয় হোগড়ে, মানবাধিকার কর্মী রবিন নায়ার ও সাংবাদিক প্রশান্ত ট্যান্ডন তাদের সাম্প্রতিক আসাম সফরের অভিজ্ঞতা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তারা বলেন, আমরা সবাই জানি আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে আসামের গোয়ালপাড়ায়। সবচেয়ে আশ্চযর্জনক ঘটনা হচ্ছে, নির্মাণ কাজে নিযুক্ত কয়েকশ শ্রমিক সম্ভবত নিজেরাই জানে না যে, তারা যে ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণ করছে, ভবিষ্যতে সেটাই হবে তাদের ঠিকানা।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের অন্যতম সদস্য নবীন খান বলেন, নির্মাণ কাজে জড়িত অধিকাংশ শ্রমিকের নাম এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ভয়ের কারণে তারা সেটা মুখ ফুটে ঠিকাদারকে বলতেও পারছে না। কারণ মুখ খুললে যদি কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়। ডিটেনশন ক্যাম্প যারা নির্মাণ করছেন ভবিষ্যতে তারাই যদি সেই ক্যাম্পের বাসিন্দা হন, তাহলে এর থেকে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
এনআরসি ছুট লোকেরা যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আপিল করবেন সেই ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের নিরপেক্ষতা ও কর্মপন্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংগঠনটি। ‘ইউনাইটেড এগেনস্ট হেট’-এর আশঙ্কা মাত্র ৮০ হাজার রুপি বেতন এবং একটি গাড়ির জন্য ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব আবেদনকারীদের বিদেশি বলে রায় দেবে।
এদিকে দিল্লিতে করা সংবাদ সম্মেলনে এপিডব্লিউ’র প্রধান অভিজিৎ শর্মা দাবি করেন, এনআরসি তালিকায় অন্তত ৮০ হাজার সন্দেহভাজন অবৈধ বাংলাদেশির নাম ঢুকে পড়েছে। এ ব্যাপারে তার হাতে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। কলকাতা পুলিশের হাতে আসামের জঙ্গি ধরা পড়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর আসামের এনআরসিতে বাংলাদেশি কোনো জঙ্গির নাম থাকার বিষয়টি কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে আসামের নাগরিকপঞ্জি সমগ্র দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে দাবি তার।
এনআরসিতে ঢুকে পড়া অবৈধ বাংলাদেশির তথ্য যুক্ত করে বুধবার সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা হলফনামার মাধ্যমে তারা সদ্য প্রকাশিত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকার একশ শতাংশ রি-ভেরিফিকেশনের আবেদন জানায়। একই সঙ্গে রি-ভেরিফিকেশনের সময় এনআরসি কর্তৃপক্ষ এবং শীর্ষ আদালতের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য আদালতে একটি ন্যায়িক কমিটি করারও আবেদন জানায় এপিডব্লিউ।
এর আগেও সংগঠনের পক্ষে আদালতে অনুরূপ আবেদন জানানো হয়েছিল। তবে আদালত তাদের আবেদনে কোনো গুরুত্ব প্রদান করেনি জানিয়ে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শর্মা। তিনি আরও অভিযোগ করেন, এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা বহুবার আদালতকে বিপথে পরিচালিত করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে এপিডব্লিউর প্রধান আরও বলেন, আদালত এবং এনআরসি কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় না থাকার কারণে আসামের জনগণ এমন একটি নাগরিকপঞ্জি পেয়েছে যা এখন অতি বিপজ্জনক। এপিডব্লিউ বুধবার এনআরসির রি-ভেরিফিকেশনের জন্য প্রথম একটি হলফনামা আদালতে দাখিল করে। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে আদালতে আরও একটি হলফনামা দাখিল করা হবে বলে এর সাধারণ সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি তালুকদার জানান।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে ত্রুটিপূর্ণ এনআরসির জন্য নবায়নের কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যারকে দায়ী করেছে এপিডব্লিউ। দ্বিতীয় হলফনামায় সফটওয়্যারটি ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি অডিটের আবেদন জানিয়েছে তারা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি সংস্থার মাধ্যমে অডিট করার জন্য এপিডব্লিউ সরকারের কাছে বুধবার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়ায় খরচ হওয়া ১৬০০ কোটি রুপি কখন কোথায় খরচ হয়েছে এ ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানায় সংগঠনটি। ধ্রুবজ্যোতি তালুকদার জানান, ইডির মাধ্যমে এনআরসি সংক্রান্ত আর্থিক অনিয়মের তদন্ত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এছাড়া এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় জঙ্গিদের নাম ঢুকে পড়ার অবকাশ থাকায় সমগ্র বিষয়টি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা ‘নিয়া’র মাধ্যমে তদন্ত করা উচিত বলে মনে করেন ধ্রুবজ্যোতি তালুকদার।