জাতীয় দলে আমার সাবেক তিন সতীর্থ এখন নির্বাচক। সেই ফারুক আহমেদ, মিনহাজুল আবেদীন ও হাবিবুল বাশার মিলেই ঠিক করবেন বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন-সৈনিকদের। তাঁদের কাজটি কঠিন নিঃসন্দেহে। তবে এই মুহূর্তে আমার কাঁধে যে দায়িত্ব বর্তেছে, সেটি নির্বাচকদের চেয়েও শক্ত। তাঁরা তো প্রিমিয়ার ক্রিকেটের সুপার লিগ শেষে ১৫ জনের দল দেবেন। আমাকে দিতে হচ্ছে এখনই!
সম্ভাব্য ১৫ ক্রিকেটারের অন্তত ৯-১০ জন অস্ট্রেলিয়ার বিমানে একরকম চড়েই আছে। স্কোয়াডে তাদের জায়গা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই কারো। কিন্তু বাকি পাঁচ-ছয়টি জায়গা? এখানে নানা মুনির নানা মত। এখানেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস। আমি সত্যি মনে করি, সুপার লিগের সুপার পারফরম্যান্স ওই ফিফটি-ফিফটি সুযোগ থাকাদের মধ্যে কাউকে এনে দিতে পারে বিশ্বকাপের টিকিট। এই যে মোহামেডানের বিপক্ষে নাসির হোসেন যেমন ব্যাটিং করল, আর দু-একটি ম্যাচে তেমনটা করলে ওকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় থাকবে?
সুপার লিগের পারফরম্যান্সটা তাই অনেকের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেহেতু দল করছি এখন, সে কারণে বতর্মান বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই সেটি করতে হচ্ছে। হয়তো সুপার লিগের পর হলে নিজের দলে নিজেই দু-একটি পরিবর্তন করতাম।
আমার দলের ওপেনার তামিম ইকবাল ও এনামুল হক। দুজনেই বড় স্কোর করতে পারে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে একসঙ্গে মিলে বড় বড় জুটিও গড়েছে। এই জায়গায় দুশ্চিন্তা তাই তেমন ছিল না। কিন্তু তামিমের হঠাৎ ইনজুরিতে বেশ খানিকটা এলোমেলো থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পরিকল্পনা। কোনো কারণে ও খেলতে না পারলে আমি লিটন দাসকে নেব। আবাহনীর হয়ে লিগে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পুরস্কার হবে সেটি। তবে তামিম ফিট হলে স্কোয়াডে জায়গা নেই লিটনের।
ওয়ানডে ক্রিকেট ৫০ ওভারের খেলা। দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের এখানে সবচেয়ে বেশি ওভার খেলতে দেওয়া দরকার। মুশফিকুর রহিম কিংবা সাকিব আল হাসান যেহেতু তিনে খেলতে অভ্যস্ত না, আমি তাই তাদের চারে-পাঁচে খেলাব। তিনে খেলবে যে মমিনুল হক, ওর ওপরও আমার অনেক আস্থা। ওয়ানডেতে এখনো হয়তো নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি। তবে টেস্টে যার অমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তার জ্বলে ওঠা কেবল সময়ের ব্যাপার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে মাহমুদ উল্লাহ চার নম্বরে ভালো করেছে। তার পরও ছয়ের আগে বিশ্বকাপ একাদশে ওকে খেলানোর সুযোগ দেখছি না। দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ভালো করে ফর্মে এসেছ, এখন নিজের জায়গা ছয়ে চলে যাও- মাহমুদের প্রতি টিম ম্যানেজমেন্টের নির্দেশনা হওয়া উচিত এমন। নইলে মুশফিক-সাকিবের ব্যাটিং প্রতিভার প্রতি সুবিচার হবে না।
আমার একাদশের সাত নম্বরে আসবে সাব্বির রহমান। দারুণ ব্যাটিং, দুর্দান্ত ফিল্ডিং আর বুদ্ধিদীপ্ত লেগ স্পিনে ওকে বলব ‘প্যাকেজ ক্রিকেটার’। যেকোনো উইকেটে যেকোনো সময়ে নেমে জড়তাহীন সাবলীল ব্যাটিং করতে পারে। আর শেষ পাওয়ার প্লে কিংবা স্লগ ওভারে সাব্বিরের লেগ স্পিনও যথেষ্ট কার্যকর। বিশ্বকাপের প্রতিপক্ষ দলগুলোকে চমকে দিতে পারে ও।
একাদশে স্পেশালিস্ট তিন পেসার আমি খেলাতে চাই। সেখানে মাশরাফি বিন মর্তুজার দলে জায়গা নিয়ে প্রশ্ন নেই। আল-আমিন হোসেনকে রাখছি নতুন বলে সুইং করানোর সহজাত সামর্থ্যের জন্য। একটা সময় সৈয়দ রাসেল এই কাজটি পারত দারুণ। পাওয়ার প্লে শেষে ওয়ান চেঞ্জে ব্যবহার করতে চাই তাসকিন আহমেদের নির্ভেজাল গতিকে। আর স্পিন আক্রমণে সাকিবের সঙ্গে তাইজুল ইসলাম। বোলিংয়ে যার বৈচিত্র্য বেশ, বাঁহাতি অফ স্পিনার হিসেবে নিয়ন্ত্রণও নজরকাড়া।
এবার আসি স্কোয়াডের বাদবাকি চারজনে। জিম্বাবুয়ে সিরিজের শেষ দিকে দেখলাম নির্বাচক-টিম ম্যানেজমেন্ট হঠাৎ হন্যে হয়ে খুঁজছে সিমিং অলরাউন্ডার। আমার প্রশ্ন হলো, সেটি এত দিনে কেন? অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ হবে মাথায় রেখে আরো এক-দেড় বছর আগে কি মুক্তার আলীকে তৈরি করা যেত না? নির্বাচকরা সেটি করেননি। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা এমন উইকেটে হচ্ছে যে, প্রথম ওভার থেকে স্পিনার নিয়ে আসছে অনেক দল। মুক্তার কিংবা জিয়াউর রহমানকে এভাবেই রেস থেকে ছিটকে দেওয়া হয়েছে। এমন কাউকে পাচ্ছি না বলে একজন পেসার নিচ্ছি ব্যাকআপ হিসেবে। সেটি রুবেল হোসেন কিংবা আবুল হাসান না, শফিউল ইসলাম। আমাদের পেসারদের যে গতি তাতে বিশ্বকাপের প্রবল প্রতিপক্ষদের বাউন্সার দিয়ে খুব লাভ হবে না। সেটি ওদের কাছে মিডিয়াম পেস বোলিং। এর চেয়ে আমি বরং সুইংয়ের দিকে ঝোঁকার পক্ষপাতী। সে কারণে শফিউল, আল-আমিনদের নিচ্ছি। আর আমাদের দুটো খেলা নিউজিল্যান্ডে আছে বলে সেখানে সুইং বোলাররা আরো অনেক কার্যকর হবেন।
স্পিনে আবদুর রাজ্জাকের কথা ভেবেছিলাম। ওর অভিজ্ঞতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরো ৫০ ওভার চটপটে থাকার মতো ফিটনেস হয়তো এই মুহূর্তে ওর নেই। রাজ্জাককে তাই রাখতে পারছি না। অনেকক্ষণ চিন্তা করেছি জুবায়ের হোসেনের ব্যাপারেও। শেষ পর্যন্ত লাল কালিতে কেটে দিতে হলো নামটি। কারণ ছেলেটিকে আমি নষ্ট করতে চাই না। ক্লাব দলেই যেখানে জুবায়ের খেলছে না, সেখানে জাতীয় দলে নিই কিভাবে! কোনো কারণে অল্পবয়সী এই লেগ স্পিনার ছন্দ হারিয়ে ফেললে বিশ্বকাপের স্কোয়াড নেমে আসবে ১৪ জনে। ওর অভাবটা বরং সাব্বিরের লেগ স্পিনে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী আমি। আর স্পিনে বিকল্প হিসেবে রাখছি আরাফাত সানিকে। এই বাঁহাতি স্পিনারদের সুবিধা আছে। মার খেলেও ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে বেশি। আর সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্সের কারণে আরাফাত এগিয়ে গেছে অন্যদের চেয়ে।
টপ অর্ডারে বিকল্প হিসেবে ইমরুল কায়েস আমার পছন্দ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অচেনা উইকেট-কন্ডিশনে আমাদের টপ অর্ডারের ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগা স্বাভাবিক। টপ অর্ডারের ধসে যাওয়া তাই অস্বাভাবিক না। অমনটা হলে ইমরুল একাদশে এসে স্থিতি দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। ওর কাছে স্থিতি আশা করছি আর নাসিরের কাছ থেকে ঝড়। চেনা নাসির অচেনা হয়ে উঠেছে ইদানীং। তবে অনেক দিন পর মোহামেডানের বিপক্ষে ওর ব্যাটে আবার দেখলাম সেই বিস্ফোরণ। সুপার লিগটা ভালোভাবে কাজে লাগানের চ্যালেঞ্জ এখন নাসিরের।
বিশ্বকাপ-টিকিটের ইঁদুরদৌড়ে আছে এমন আরো অনেকজন। সুপার লিগ পারফরম্যান্স দিয়ে যারা পাল্টে দিতে পারে নির্বাচকদের মনোজগৎ। আর অমন মধুর সমস্যায় পড়তে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই আমার জাতীয় দলের সাবেক তিন সতীর্থের!
খালেদ মাসুদের বিশ্বকাপ স্কোয়াড
তামিম ইকবাল, এনামুল হক, মমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, মাহমুদ উল্লাহ, সাব্বির রহমান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাসকিন আহমেদ, আল-আমিন হোসেন, তাইজুল ইসলাম, ইমরুল কায়েস, শফিউল ইসলাম, আরাফাত সানি ও নাসির হোসেন।
প্রথম ম্যাচের একাদশ : তামিম, এনামুল, মমিনুল, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদ, সাব্বির, মাশরাফি, তাসকিন, আল-আমিন ও তাইজুল।