ঢাকা: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৭৮ সালের এই দিনে দলটির যাত্রা শুরু হয়। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। দলীয় প্রধান কারাগারে। তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, নতুন নির্বাচনের দাবি আদায় আর দল গোছানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে পথ হাঁটছে দলটি। একই সঙ্গে বিগত নির্বাচনের আগে গড়া নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির পুরনো মিত্র ২০ দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয় অক্ষুণ্ন রেখে সামনে চলাকেও বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি যে রাজনীতি করছে সেটা বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। আর সেটা থেকে উত্তরণের জন্য বিএনপির রাজনৈতিক পন্থা আরো সময় উপযোগী হওয়া প্রয়োজন।
অনেকেই বলেন, বিএনপি যে রাজনীতি করছে সেটা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবে চলছে। বিএনপির রাজনীতি আরো সময় উপযোগী করতে হবে।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বিএনপির রাজনীতির মূল্যায়ণ করে বলেন, দলটির প্রধান খালেদা জিয়া মাত্র দুই কোটি টাকার জন্য জেল খাটছেন। অথচ দুই কোটি টাকার একটিও অপচয় হয়নি। কিন্তু এই দেশে হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে তাদের কিছুই হচ্ছে না। সবাই প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে আছে। বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী জেল খাটছে। মামলা হামলার শিকার হয়েছে। কোন প্রোগ্রাম করতে পারছে না। কিন্তু সবচেয়ে খুশির খবর হচ্ছে দলটি এখনো অক্ষত রয়েছে। দলের মধ্যে কোন বিভাজন হয়নি। দলের কার্যক্রম চলছে। তবে প্রত্যাশিত কার্যক্রম তেমন হচ্ছে না। এখন বিএনপিকে হিসেব করে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হবে। আর দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো আরো শক্রিশালী করে গণতান্ত্রিক লাড়াইয়ে নামতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশকে বাঁচাতে হবে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। দেশের গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। আর আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা। এইসব উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে আমরা সামনের দিনগুলোতে কাজ করে যাব।
দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির উদ্দেশ্য একটাই, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, মানুষের অধিকার যেগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে এগুলো ফিরিয়ে আনা। এগুলো সামনে রেখেই আগামীতে বিএনপি এগিয়ে যাবে। সামনেই ছাত্রদলের কাউন্সিল। এরপরে যেসকল বিভাগে সমাবেশ বাকি রয়েছে এগুলো সম্পন্ন করা এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন আরো বেগবান করা।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিএনপি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৬টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ১০টায় দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানানো। বিকাল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে আলোচনা সভা। এ ছাড়া সারা দেশের মহানগর, জেলা-উপজেলা, থানা, পৌরসভাসহ বিএনপির সব ইউনিট ও অঙ্গ সংগঠনগুলো নানা অনুষ্ঠান পালন করবে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রাজধানীর রমনা রেস্তোরাঁয় দলের প্রতিষ্ঠাতা সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় ২ ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে) এই ৪ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার উত্থান ঘটানো। এগুলোর ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান তার ১৯ দফা ঘোষণা করেন।
বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল সে সময়ের উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই জাগদল বিলুপ্ত ঘোষণা এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সব সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত বিএনপিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। গঠনের সময় থেকেই বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতির সরকার সমর্থন করে আসছিল। ১৯৮১ সালের ৩০মে চট্টগ্রামে বিদ্রোহী সেনাদের হাতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে সে সময়ের উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিএনপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ হলে ১৯৮৪ সালের ১০ই মে দলের চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়া। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫ বছর ৩ মাস ধরে তিনি দলটির হাল ধরে আছেন। প্রতিষ্ঠার পর দলটি ৪ দফা ক্ষমতায় ছিল। ২ দফা ছিল জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল।