রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচন: এরশাদের দুই ছেলে সহ একই পরিবারের ৪ প্রার্থী

Slider বাংলার মুখোমুখি রংপুর


ঢাকা: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপনির্বাচন ঘিরে জমে উঠেছে ভোটের প্রস্তুতি। দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসন ধরে রাখতে মাঠে নেমেছেন দলের বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা। অন্যদিকে প্রার্থী হওয়া নিয়ে এরশাদের পরিবারের সদস্যরাই চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রার্থী বিষয়ে মীমাংসার উদ্যোগ নিলেও এরশাদ পরিবারে দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে গেছে বলে জানা গেছে।

গতকাল দুপুরে জাতীয় পার্টিররংপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসীরের পক্ষে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ। দলের বনানী কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয়। এরশাদ-বিদিশার ছেলে হলেন এরিক।

অন্যদিকে এরশাদ-রওশনের ছেলে রাহগীর আল মাহী সাদকে প্রার্থী করতে এরশাদ পরিবারের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টির একটি সূত্র জানায়, রওশন এরশাদ তাঁর ছেলে সাদকে প্রার্থী করা নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিপাকে পড়েন। অন্যদিকে এরশাদের ভাতিজা সাবেক সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে সোমবার নগরীতে বিশাল শোডাউন করেছেন। এরশাদের ভাগ্নি ও দলের নেতা জিয়াউদ্দিন বাবলুর স্ত্রী মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পা, আরেক ভাতিজা মেজর (অব.) খালেদ আখতার ও আমেরিকাপ্রবাসী এরশাদের ছোট ভাই অপেলও মনোনয়ন চাইছেন।

এ ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসীর ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক শিল্পপতি এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীরও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রার্থী।

এরশাদপুত্র সাদ প্রচারের মাঠে না থাকলেও এখন নিয়মিত রংপুর সফর করছেন। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দলের মহাসচিবের সঙ্গে এখন তাঁর সখ্যও বেড়েছে।

জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র সাদকে প্রার্থী করার বিষয়ে পারিবারিক সমঝোতার বিষয়টি স্বীকার করেছে। এরশাদের আসনে অন্য কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যকে মনোনয়ন দিয়ে আসনটি পরিবারের মধ্যে রাখার ব্যাপারে তাঁরা একমত হন, কিন্তু এরিক এরশাদ নিজে উপস্থিত হয়ে এস এম ইয়াসীরের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করায় সাদকে প্রার্থী করার পারিবারিক সমঝোতা নিয়ে চরম আশঙ্কা তৈরি হলো।

দলের একটি সূত্র জানায়, এরশাদের আসনে উপনির্বাচনে সাদকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে মূলত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দেবর-ভাবির বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন দলের রওশনপন্থী বলে পরিচিত নেতারা।

নাম প্রকাশ না করে দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরিক এরশাদ প্রকাশ্যে ইয়াসীরের পক্ষে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। সাদকে প্রার্থী করা হলে এরিক ইয়াসীরের পক্ষে সরাসরি ভোটের মাঠে প্রচারে নামবেন। এতে এরশাদ পরিবারের বিরোধ আরো বেশি মাত্রায় প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এরশাদের ভাবমূর্তি।’

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি বছরের ৩ মার্চ রংপুরে এরশাদের শেষ সফরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ আরো বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার উপস্থিতিতে তিনি তাঁর পুত্র এরিককে ইয়াসীরের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন—এরিক তোমার ভাই, এটাই হয়তো রংপুরে আমার শেষ সফর, আর মনে হয় আসতে পারব না, তুমি এরিককে দেখে রেখো।’

জাতীয় পার্টির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এরই মধ্যে এরশাদ-বিদিশার ছেলে এরিক ও এরশাদ-রওশনের ছেলে সাদের মধ্যে ব্যাপক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্রটি জানায়, কয়েক দিন আগে এরশাদের বারিধারার বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে চারটি ঘড়ি নিয়ে যান সাদ। ওই ঘড়িগুলো ট্রাস্টের সম্পত্তি দাবি করে গতকাল সাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার উদ্যোগ নেন এরিক। পরে পরিবারের একজন মুরব্বি এরিককে মামলা করা থেকে বিরত রাখেন।

দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা দাবি করেন, দলের জন্য নিবেদিত, ত্যাগী ও গ্রহণযোগ্যতা আছে—এমন কাউকে রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী করার প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে উপনির্বাচনে এরশাদের ভাতিজা আসিফের মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে স্বজনদের বেশ কয়েকবার বাগিবতণ্ডা হয়েছে। এর মধ্যে গত সোমবার আসিফ রংপুর নগরীতে বিশাল শোডাউন করেছেন, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিজেই। আসিফ ঘোষণা দিয়েছেন যে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া না হলেও তিনি নির্বাচন করবেন।

রংপুরের নেতাকর্মীরা বলছে, এলাকায় পরিচিত প্রার্থী দিতে যদি জাতীয় পার্টি ব্যর্থ হয়, তাহলে চরম খেসারত দিতে হবে। এমনকি পরবর্তী নির্বাচনগুলোতেও এ খেসারত দিয়ে যেতে হবে। তাই প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দাবির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

মনোনয়নপ্রত্যাশী রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসীর বলেন, ‘আমি তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আসছি। দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ অনেকেই আমাকে উপনির্বাচন করতে বলেছেন। তাই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি, মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। আমার বাসা ঢাকায় নয়। আমি রংপুরের সন্তান, রংপুরেই থাকব। নির্বাচিত হলে স্যারের (এরশাদ) স্বপ্ন পূরণে কাজ করব।’

গত সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টি মাত্র দুটি আসনে জয় পেয়েছিল। টানা ২৮ বছর পর এবার এরশাদের অবর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ এ আসন জাতীয় পার্টির দখলে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।

গত ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য হয় রংপুর সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ২৫টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত গুরুত্বপূর্ণ এই আসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *