ঢাকা: ঈদযাত্রায় এবার দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২০৩টি দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত ও ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। এছাড়া সড়ক রেল ও নৌ-পথে সম্মিলিতভাবে ২৪৪টি দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৯০৮ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক এই প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৬ আগস্ট থেকে ঈদুল আজহা শেষে বাড়ি থেকে মানুষের কর্মস্থলে ফেরা অবধি ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত ও ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ১১টি, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১টি , ট্রেন ও যানবাহন সংঘর্ষে ১টি, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ১টি ঘটনায় মোট ১৩ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। একই সময়ে নৌ-পথে ২৪টি ছোটখাট বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, ৫৯ জন নিখোঁজ ও ২৭ জন আহত হয়।
মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বিগত ঈদের চেয়ে এবার রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো ছিল। নৌ-পথে বেশ কিছু নতুন লঞ্চ বহরে যুক্ত হয়েছে, রেলপথেও বেশ কয়েক জোড়া নতুন রেল ও বগি সংযুক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এবারের ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, যানজটের ভোগান্তি, রেলপথে সিডিউল বিপর্যয় ও টিকিট কালোবাজারি, ফেরি পারাপারে ভোগান্তিসহ নানা কারণে যাত্রী হয়রানি বেড়েছে। ঈদুল ফিতরের ন্যায় এবারের ঈদের লম্বা ছুটি থাকায় যাত্রীসাধারণকে আগেভাগে বাড়ি পাঠানোর সুযোগ কাজে লাগানো গেলে ঈদযাত্রা আরও স্বস্তিদায়ক করা যেত।
তিনি বলেন, রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতিসহ সার্বিক পরিকল্পনা এবং বিগত ২০১৬ সাল থেকে ঈদযাত্রায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির ধারাবাহিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনসমূহ গণমাধ্যম ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগানোর কারণে এবারের ঈদে বিগত বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, নিহতের সংখ্যা ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও আহতের সংখ্যা ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবছর মোট সংঘটিত ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনার ৬৭টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। যেখানে মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং মোট আহতের ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ। আগামী ঈদে এ দুই ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৮৫ দশমিক ২১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য ৪১টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং ১১টি অনলাইন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ৯টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে– ১. বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো; ২. ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন; ৩. পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের নিষেধাজ্ঞা অমান্য; ৪. অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো; ৫. বিরামহীন ও বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানো; ৬. মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত রিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল; ৭. সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা; ৮. ঈদ ফেরত যাতায়াতে মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা বা মনিটরিং এ শিথিলতা; ৯. মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রা।
প্রতিবেদনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ১২টি সুপারিশও তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে– ১. চালক প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স ইস্যু পদ্ধতি আধুনিকায়ন, যানবাহনের ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি আধুনিকায়ন, রাস্তায় ফুটপাত-আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ, জেব্রা ক্রসিং অংকন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও গবেষণা, ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ সড়ক নিরাপত্তায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; ২. জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা; ৩. চালক প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা; ৪. ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা; ৫. ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা; ৬. মহাসড়কে গতি নিরাপদ করা, ধীরগতি ও দ্রুত গতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা; ৭. মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রা নিষিদ্ধ করা; ৮. ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধের আদেশ শতভাগ কার্যকর করা; ৯. সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে যেসব সুপারিশ প্রণীত হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা; ১০. ঈদের আগের ন্যায় ঈদের পরেও সড়ক-মহাসড়কে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদাড় রাখা; ১১. চালক-শ্রমিকদের যুগোপযোগী বেতন, বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিরতি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা; ১২. যানবাহনের যাত্রার আগে ত্রুটি পরীক্ষা করা।