ঢাকা: তিনশ ফিট সড়ক এলাকার হাটের ফটক থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছেন শামীম হোসেন। সঙ্গে আরো দুজন। বিশালাকার গরুটি দেখে হাটের ভেতর প্রবেশগামী আরো কয়েকজন উচ্চস্বরে জানতে চাইলেন ভাই কত, কত? হাস্যজ্বল চেহারায় শামীম হোসেন বলেন, ১ লাখ ৭৬। এভাবেই হাটে প্রবেশ-বাহির হওয়ার সময় একে অপরকে জিজ্ঞাস করছেন গরুর দাম। ফটকের অবস্থা বলে দিয়েছে শেষ মুহূর্তের কোরবানির পশুর হাটের হালচাল। শুরুর কয়দিন অলস সময় কাটলেও শেষ মুহূর্তে পুরোদমে জমেছে পশুর হাট। এই অবস্থা থাকবে আজ গভীর রাত পর্যন্ত। কোরবানির পশুর হাটে এমন তুমুল ব্যস্ত সময় কাটলেও দাম নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না ক্রেতারা।
পছন্দের গরু-ছাগল কিনে বাড়ি ফিরছেন ঠিক, তবে বাজেটের বেশি টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে গতকালও। তিনশ ফিটে সড়ক সংলগ্ন হাট থেকে গরু নিয়ে ফেরা শামীম হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, হাটে বেচাকেনা প্রচুর হচ্ছে। কোরবানির নিয়ত যখন করেছে সবাইকেই তো কিনতে হবে। কিন্তু ব্যাপারীরা দাম ছাড়ছেন না। ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা দিয়ে যে গরুটি কিনলাম সেটি গত বছর কিনেছি দেড় লাখ টাকায়। এবার বাজেটের বেশি হয়ে গেছে। ব্যাপারীরা একটা দাম বলেই আর কথা বলতে চান না। হাটে গরু কিনতে আসা মাহবুব উল করিম জাফর বলেন, পুরো হাট ঘুরে দেখলাম, এবার গরুর দাম অনেক। মাঝারি সাইজের গরু খুঁজছি। এর মধ্যে যেটাই ধরেছি দাম আশি হাজারের বেশি। আমার বাজেট ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে খুঁজতে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই দামের মধ্যে যা আছে সেগুলো ছোট হয়ে যায়। এদিকে একই হাটে লিংকন নামের আরেক ক্রেতা গরু কিনতে আসেন বাড্ডা থেকে। তিনি ৭৪ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছেন। লিংকন বলেন, গরুটির দাম আরেকটু কম হলে ভালো হতো। এই ক্রেতা আরো বলেন, কোরবানি দিচ্ছি আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায়ের জন্য। দাম একটু বেশি হলেও খুশি। আল্লাহ যেটা কপালে রেখেছেন সেটাই আমি পেয়েছি। তিনশ ফিট সড়কের ওই হাটের ভেতরে গিয়ে আরো বেশি ভিড় লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি গরুর সারিতে ক্রেতাদের দর কষাকষির গল্প শোনা গেছে। এই হাটে কুষ্টিয়া থেকে গরু নিয়ে আসা সালাম মিয়া বলেন, ৮টি গরু নিয়ে আসছি। এর মধ্যে আজ (গতকাল) সকালেই তিনটা বেচা হয়ে গেছে। এই ব্যাপারী জানান, একেকটি গরু ১ লাখ ২০ টাকার মধ্যে বিক্রি করার ইচ্ছা রয়েছে। তবে সকাল থেকে যে তিনটি বিক্রি করেছেন সেগুলোর একটি ৯৫ হাজার ও বাকি দুটি ১ লাখ টাকা করে ছেড়েছেন। সুরুজ আলী নামের আরেক ব্যাপারী ফরিদপুর থেকে ১৫টি গরু এনেছেন। দাম বেশি চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এবার খরচ বেশি হয়েছে। আমাদের একেকটা গরুর জন্য ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ গেছে। এখন লাভ না নিয়ে বাড়ি ফিরি ক্যামনে। ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আনছি একটু বেশি দাম পাওয়ার জন্য।
কোরবানির পশুর হাটের জমজমাট চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর আরেক হাট মেরাদিয়া বাজারের পাশে। সেখানেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পশু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারীরা। পর্যাপ্ত পশু যেমন আছে রয়েছে তেমনি ক্রেতার সংখ্যাও রয়েছে ব্যাপক। শেষ মুহূর্তে বিকিকিনিতে ব্যস্ত সবাই। তবে এই হাটেও ক্রেতাদের রয়েছে দাম নিয়ে অভিযোগ। অন্য বারের চেয়ে গরু প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি চাওয়া হচ্ছে। রাহাত মাহমুদ নামের একজন ক্রেতা বলেন, গরুতে হাত দিলেই দাম আর পছন্দ হয় না। প্রচুর দাম। ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকার যে গরু সেটি ৭৫ থেকে ৮০ পর্যন্ত হাঁকাচ্ছেন ব্যাপারীরা। দরদাম করলে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকায় রাজী হবে। কিন্তু গতবারের চেয়ে এত পার্থক্য হবে সেটা চিন্তার বাইরে। আবার বড় গরুর দামও বেশি বলছেন ব্যাপারীরা। পুরো হাট এর মধ্যে ঘুরে ফেললাম। মন মতো হচ্ছে না। দেখি বিকাল পর্যন্ত হয়তো আবার আসবো। নারায়ণগঞ্জ থেকে গরু নিয়ে মেরাদিয়ার হাটে আসা এক ব্যাপারী বলেন, ৬টা গরু আনছি। ৪টাই বিক্রি হয়ে গেছে। সব গরুই সমান সাইজের। এখন বাকি দুইটা বেচতে পারলে বাড়ি চইলা যামু। মিরপুর ৬ নং সেকশনের হাটের চিত্রও বেশ জমজমাট ছিল গতকাল। দিনভর চলেছে বিকিকিনি। এই হাটে বড় গরুর পাশাপাশি বেশি লক্ষ্য করা গেছে মাঝারি গরুর চাহিদা। তবে দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন ক্রেতারা। অন্যদিকে ব্যাপারীরাও বলছেন প্রত্যাশা অনুযায়ী গরু বিক্রি করতে পারছেন না। আব্দুর রশিদ নামে এক ক্রেতা বলেন, মাঝারি আকারের গরু কিনতে এসেছি। কিন্ত বড় গরুর তুলনায় মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতারা। না পারছি বড় গরু কিনতে, না পারছি মাঝারি গরু কিনতে। তিনি জানান, বাজেট ছিল ৬০ হাজার। মাঝারি আকারের একটি গরু দেখে পছন্দ করেছি। বিক্রেতা দাম চাচ্ছেন ৯০ হাজার টাকা। আমি ৫৫ হাজার বলেছি। বিক্রেতা জানিয়ে দিয়েছেন ৭০ হাজারের কমে বিক্রি করবেন না। পাবনার ইশ্বরদী থেকে আসা খামারি হারুন জানান, হাটে দেশি গরুর চাহিদা বেশি, দামও বেশি। কিন্তু আমাদের লাভ কম। গরু কিনেছি বেশি দামে, তাই বেশি লাভ করতে পারছি না। ২৩টি গরু নিয়ে এসেছি। এখন পর্যন্ত একটা গরুও বিক্রি হয়নি। ঠিকমতো দাম না পেলে গরু ফিরিয়ে নিযে যাবো। রাজধানীর আফতাব নগরের হাটের চিত্রও আগের দুদিনের চেয়ে বেশি জমজমাট ছিল গতকাল। হাটে পশুর সংখ্যাও বেড়েছে। আনাগোনা করছেন ক্রোতারাও। তবে দাম নিয়ে সব ক্রেতার মাঝে এক ধরণের ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে জানান, ব্যাপারীরা নিজের ইচ্ছা মতো দাম ধরে রেখেছেন। শেষ মুহূর্তে এসেও দাম কমাচ্ছেন না কেউ। ফারুক হোসেন নামের একজন বলেন, ব্যাপারীদের কাছে যেন সবাই জিম্মি। এমন এমন দাম বলে অবাক হয়ে যাই। যে গরু ৯০ হাজার টাকা, সেটা বলে বসে দেড় লাখ।