ঢাকা: প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যু। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা এক শ’ ছুঁই ছুঁই। রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যেও এতো প্রাণহানি কেন? এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের ডেঙ্গুর ধরণ ভিন্ন। তাই আক্রান্তদের বাঁচাতে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। গতানুগতিক চিকিৎসায় প্রাণহাণি রোধ করা যাবে না। একইসঙ্গে ডেঙ্গু সনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন। এতে তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসায় ছেদ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানালেও বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ৯০ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
এদিকে রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৩৪৮জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যা গত কয়েক দিনের ২৪ ঘণ্টার রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই এক হাজার ২৮৪ জন রোগী এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ৬৪ জন ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৯৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ৯১২ জন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। গতকালও ঢামেক হাসপাতালে তিনজন ও অন্যান্য হাসপাতালে আরও তিনজন সহ সারা দেশে নয়জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এদের মধ্যে ঢাকায় দুই নারী ও তিন পুরুষ, দিনাজপুরে এক কিশোর এবং রংপুর ও চাঁদপুরে একজন করে শিশু রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসাধীন তিন জনের মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এরা হলেন-ফরিদপুরের হাবিবুর রহমান (২১) মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেতুয়াধারা গ্রামের কৃষক আমজাদ মণ্ডল (৫২) ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের আহমেদপুরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৭২)। এদিকে স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে বেড়াতে এসে ডেঙ্গুত আক্রান্ত হয়ে ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মারা যান ইতালি প্রবাসী হাফসা লিপি (৩৪)। ওই নারী চার দিন ধরে সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় সোমবার রাতে তার মৃত্যু হয়। রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে, আগস্ট মাসের ৬ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৪৫১ জন। গত জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ১৬ হাজার ২৫৩ জন। এই সংখ্যা জুন মাসে ছিল এক হাজার ৮৮৪ জন। মে মাসে ১৯৩ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২১ হাজার ৯২১ জন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৯৬৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এপ্রিলে দুইজন, জুনে তিনজন, জুলাই মাসে ১৫ জন এবং আগস্টে তিনজন মারা গেছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দিন দিন মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। কেন ? এ বিষয়ে কথা হয় দেশের কয়েজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। আইইডিসিআর’র (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, মৃতের সংখ্যা কমাতে হলে হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। এটা ডেঙ্গুর গাইডলাইন অনুযায়ী কয়েকভাগে ভাগ করতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে রোগী ও তার স্বজনদের। দেরিতে আসলে ক্ষতিটা বেড়ে যায়। রোগীদেরও সচেতন হতে হবে। তাহলে মৃতের সংখ্যা কমে যাবে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এল ই ফাতমী মানবজমিনকে বলেন, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ এবার রোগী বেশির ভাগই শক সিন্ড্রোম আসছে। শক সিন্ড্রোম অর্থ হচ্ছে পালর্স (নাড়ির গতি) পাওয়া যায় না। এবার ডেঙ্গুর প্যাটার্নটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের সবার প্ল্যাটিলেট কমে যাচ্ছে, সবাই শকে চলে যাচ্ছে। জ্বর হলে গাফিলতি না করে দ্রুত হাসপাতালে চলে আসতে হবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
ডেঙ্গু কেড়ে নিলো মদিনার প্রাণ
মতলব উত্তর (চাঁদপুর) প্রতিনিধি জানান, ডেঙ্গু কেড়েনিল মতলব উত্তর উপজেলার শিশু মদিনার প্রাণ। সোমবার রাত ১২টার দিকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মদিনা আক্তার (৮) প্রাণ হারায়।
মদিনার বাড়ি মতলব উত্তরের ছেংগারচর পৌরসভার ছোট ঝিনাইয়া গ্রামে। স্থানীয় অক্সফোর্ড কিন্ডারগার্ডেনে কেজি ওয়ানে পড়ুয়া মদিনা ডেঙ্গু আতঙ্কের কথা তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বলতো। কে জানতো সেই ডেঙ্গুই যে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে যাবে। ঝিনাইয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে মশা কামড় দেয়ার বিষয়টি মদিনা প্রথমে তার মাকে জানায়। মা প্রথমে এ বিষয়ে গুরুত্ব না দিলেও পরের দিনই স্থানীয় ছেংগারচর বাজারের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। দ্রুত মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পর চাঁদপুর সদর হাসপাতালে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। চাঁদপুর থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা চলাকালীন আইসি ইউ তে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হলে সেখানে সিট না পাওয়ায় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে ভর্তি করানো হয় ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট হসপিটালে। সোমবার রাত ১২টার দিকে সেই হসপিটালে মদিনা মৃত্যুবরণ করে। মদিনা এক ভাইয়ের একটিই বোন। মা ময়না আক্তার জানান, ডেঙ্গু আতঙ্কের কথা মেয়ে আমাকে প্রায়ই জানাতো স্কুলে শিক্ষকরা নাকি ডেঙ্গুর বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক থাকতে বলতো এবং বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে বলতো। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মদিনার ভাই মেহেরাজ জানায়, বোন আমার ছিল লেখাপড়ায় ভালো এবং খুবই সচেতন। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং কোনো কিছুর মধ্যে পানি জমে না থাকার বিষয়ে আমাদের সচেতন করতো এবং ও নাকি এসব স্কুল থেকে শিখেছে।
সন্তান হারিয়ে মা ময়না আক্তার এখন দিশাহারা কেবলই কাঁদছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ঝিনাইয়া এলাকায় পারিবারিক গোরস্তানে মদিনার লাশ দাফন করা হয়।
দিনাজপুরে কিশোরের মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর থেকে জানান, দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রবিউল ইসলাম (১৭) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালটিতে আরো ৪৬ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। নিহত রবিউল ঠাকুরগাঁও রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে। গত ৩০শে জুলাই থেকে চিকিৎসাধীন ছিল সে। এর আগে ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় রবিউল। দিনাজপুরের এম. আবদুুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবু খয়রুল কবির জানান, হাসপাতালটিতে ১১৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে ৬৭ জন। আশঙ্কাজনক রবিউল ইসলামকে আবার ঢাকায় রেফার করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই মারা যায় সে। চিকিৎসাধীন ৪৬ রোগীর মধ্যে ৩৮ জন পুরুষ, ৮ জন নারী এবং ১ জন শিশু। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও বাড়ছে নতুন রোগীর সংখ্যা। এদিকে, একজন রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় করণীয় সম্পর্কে দুপুরে বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবু খয়রুল কবির। আক্রান্ত রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দেয়া এবং বাড়তি রোগীর চাপ সামাল দেয়াসহ ওষুধপত্র এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ সংগ্রহের বিষয়ে মতামত গ্রহণ করেছেন তিনি।
রংপুরে শিশুর মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রিহানা (৩) নামে এক শিশু মারা গেছে। বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৩ জন রোগী।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধার পলাশবাড়ির আশরাফুল ইসলামের কন্যা রিহানা ঢাকাতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। মাতুয়াইল শিশু হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সে সময় রিহানার ব্রেন শক ছিল এবং নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়। তার ব্রেনের সমস্যা ছিল, পাশাপাশি ওজনও কম ছিল। সেখানে শক সিনড্রোম হওয়ার পরও বাচ্চার অবস্থা খারাপ থাকা সত্ত্বেও পরিবারের লোকজন রংপুরে নিয়ে আসে। গতকাল সকালে তার মৃত্যু হয়। বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫১ জন পুরুষ, ৯ জন মহিলা ও ৩ জন শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬২ জন এবং ৯৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. একেএম শাহেদুজ্জামান রিবেল বলেন, আমরা হাসপাতালের নির্দিষ্ট জায়গাকে ডেঙ্গু কর্নার হিসেবে ঘোষণা করেছি। সবাই মিলে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগীদের সেবা দিতে।
সামনে রোগী বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য আমাদের ওয়ার্ডের দুটি অংশবিশেষ আমরা রেখে দিয়েছি। প্রয়োজনে নতুন রোগীদের সেখানে চিকিৎসা দেয়া হবে। আমাদের রি-এজেন্টের সমস্যা ছিল, এখন সেটি নেই। সমস্ত পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালের এনএসওয়ানের সংখ্যা ৪০টির উপরে ছিল, বর্তমানে ২০টির মতো রয়েছে। সামনে শেষ হয়ে গেলে সেটি কবে নাগাদ আসবে সেটি হাসপাতাল পরিচালকই বলতে পারবেন। নতুন করে কিটস আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে গতকাল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন বিভাগীয় কমিশনার কেএম তারিকুল ইসলাম। তিনি ডেঙ্গু কর্নার পরিদর্শন করে, রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমাদের প্রতিটি জেলায় জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিটের যে সমস্যা ছিল সেটি উত্তীর্ণ হয়েছে। ইতিমধ্যে ডাক্তার ও নার্সদের মাঝে রোগীদের সেবা দিতে পূর্ণ দক্ষতা চলে এসেছে। সকল রোগীকে মশারি দেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ীই সেবা দেয়া হচ্ছে। আমরা রোগীদের সেবা নিশ্চিতে হাসপাতালগুলো পরিদর্শনসহ মনিটরিং করছি।