মাহফুজ আনাম: আধুনিক সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। কমিউনিস্ট ব্লক ও স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষা করে প্রায় সব দেশই তাদের সংবিধানে মিডিয়ার বিশেষ সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মিডিয়ার স্বাধীনতাকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতার আশ্রয় নেয়া হতো।
সংবাদকর্মীকে জেল দেয়া ছিল বেশ বিরল। আর একটি মিডিয়া আউটলেট বন্ধ করে দেয়ার কথা তো আরো সুদূরে ছিল।
দুঃখের বিষয়, আর না।
পপুলিজম, অতি জাতীয়তাবাদ, স্বৈরতন্ত্রের উত্থান, সত্য-পরবর্তী এবং নেতার উত্থানে- যিনি কোনো অন্যায় করতে পারেন না, এমন যুগে সংবাদ মাধ্যমে নতুন এক স্বাধীনতার আবির্ভাব ঘটেছে।
এটা হলো ‘তোষামোদী স্বাধীনতা’- যেখানে প্রেস পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাধীন। কিন্তু তারা শুধু তোষামোদ করে এবং যে প্রেস যত বেশি তোষামোদি করতে পারে, তারা তত বেশি স্বাধীন বলে প্রত্যায়িত হয়।
এর একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি হলো ভুয়া খবর, ষড়যন্ত্র, জাতীয়তাবাদ বিরোধিতা, উন্নয়ন অগ্রযাত্রার বিরোধিতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিরোধিতা।
‘স্নো হোয়াইট’ নামের রূপকথায় রানীর সুপরিচিত একটি প্রশ্নের জবাবে আয়না উত্তরে বলেছিল, ‘আমার রানী, আপনিই হলেন দেশের সবচেয়ে সুন্দরী’।
আজকের বিশ্বে অধিক থেকে অধিক পরিমাণে সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা প্রত্যাশা করেন মিডিয়া হবে ওই রূপকথার আয়নার মতো, যা শুধুই প্রশংসা গাইবে। এমন আয়না হবে না, যা সমাজের বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়।
জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ সালের বিখ্যাত উপন্যাস “ওয়্যার ইজ পিস”, “ফ্রিডম ইজ স্লেভারি” ও “ইগনোরেন্স ইজ স্ট্রেংথ”-এ যেমনটা বলা হয়েছে বিশ্বের ‘তোষামোদির স্বাধীনতা’য় সত্য হলো মিথ্যা, তথ্য (ফ্যাক্ট) হলো অতথ্য (নন-ফ্যাক্ট), ভিন্ন মতাবলম্বীরা বিশৃংখলার বীজ বপন করে, জনগণকে ভুলপথে পরিচালিত করতে সরকারি ভাষ্যের বিরোধিতা করে। বিরোধীদের সুযোগ দেয়া হলো বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলা। সৃষ্টিকর্তা না করুন, ক্ষমতার সর্বোচ্চে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি প্রকাশ করা হলো দেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
যেহেতু এটা হলো মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, তারা এসবই করে। তাই তারা হলো ‘জনগণের শত্রু’।
একটি নতুন ভ্রান্ত জাতীয়তাবোধের গভীর অনুভূতি এখন ধ্বংস করে দিচ্ছে সহনশীলতা, বহু দৃষ্টিভঙ্গিকে। আর এর ফলে মুক্ত মিডিয়ার অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
আকস্মিকভাবে সত্য না বলা, যে সত্য ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘ফ্যাক্টস’কে আহত করে, তার আর তাৎপর্য নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ডানিয়েল প্যাটিক মইনিহানের বিখ্যাত বিরত থাকা বিষয়ক উক্তি হলো, নিজস্ব মতামতের অধিকারী প্রত্যেকে। কিন্তু তারা নিজস্ব কোনো ফ্যাক্টের অধিকারী নন। বর্তমানে এটাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে একটি ভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে- যদি তথ্য বা ফ্যাক্ট কোনো নির্দিষ্ট বিতর্ককে সমর্থন না করে তাহলে তা অনুসন্ধান করুন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে, একটি রাজনৈতিক সিস্টেম হিসেবে গণতন্ত্রের ইচ্ছাকৃত অবমূল্যায়ন প্রত্যক্ষ করছি।
এসব হলো ‘ঝঞ্ঝাটপূর্ণ’, ‘বিশৃংখল’, ‘দৃষ্টিভঙ্গি ওইসব মানুষের যারা অনেক জানেন না অথবা যাদের দৃষ্টিভঙ্গি দূরদর্শী নয়’, ‘সময় সাপেক্ষ’ এবং উন্নয়নে প্রয়োজন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, যা এসব বিষয় সম্পন্ন করে।
সর্বোপরি, নেতা যখন সব জানেন, তখন জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়গুলোকে বিভ্রান্ত করে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে। এই মানসিকতার মধ্যে জনমত, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় এবং অনেক বেশি প্রশ্ন তোলার জন্য মিডিয়াও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়।
এমন মানসিকতা অনিবার্যভাবে মেগা দুর্নীতিতে দায়মুক্তির একটি সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দেয় এবং হয়ে ওঠে একটি স্বাভাবিক সহচর।
‘তদারকি’ সংস্থা হিসেবে পার্লামেন্টকে প্রত্যাখ্যান করা সাম্প্রতিক সময়ের এক করুণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
অতীতে সরকারগুলো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়া ও তাতে মারাত্মক সমালোচনার ভয়ে পার্লামেন্টে মুখোমুখি হতে ভয়ে থাকতো। ভালভাবে জানা ও ব্যাপক গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আসতো ওইসব প্রশ্ন। প্রশ্ন করতেন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উচ্চ মাত্রায় প্রতিশ্রুতিশীল ও মোটিভেটেড নির্বাচিত নেতাদের পক্ষ থেকে।
পার্লামেন্টে বিরোধীদের ভূমিকাকে খর্ব করায় জবাবদিহিতায় খাতটিতে আরো বড় মাত্রা যোগ করেছে, যা আমরা সব সময়ই দেখছি।
বিচার বিভাগের অবস্থানও খুব বেশি আলাদা নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের অধিকার ও সব রকম স্বাধীনতা সুরক্ষার দিকে যায় না। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের ইচ্ছার দিকেই বেশি যায়।
দুঃখজনকভাবে, বিচার বিভাগ, আইনসভা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী শাখা, প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য (চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) ভেঙ্গে পড়েছে।
সময়ের সাথে সাথে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ক্ষমতার ভারসাম্য ধাবিত হয়েছে নির্বাহী বিভাগের পক্ষে। যা একনায়কের শাসন, নির্বাচিত ‘একনায়ক’ এবং ‘ডেমিগগস’- যারা নিজেদেরকে উপদেবতা হিসেবে উপস্থাপন করেন- তাদের উত্থানে ভূমিকা রাখে।
সর্বশক্তিসম্পন্ন নির্বাহী বিভাগের উত্থানে- অর্থাৎ সরকারগুলো- সরাসরি ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে প্রেসের ওপর যাতে তারা সরকারের সীমাবদ্ধতার অধীনে থাকে। সংবাদ মাধ্যম সরকারের ‘পর্যবেক্ষক’ বা নজরদারি হয়ে উঠায় এভাবেই মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার ক্ষেত্রে আহত করা হয়।
যখন সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পাচ্ছে তখন বাক স্বাধীনতা খুব কমই রক্ষা পেতে পারে। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতা এবং কথা বলার স্বাধীনতা, যেখানে মুক্ত সংবাদ মাধ্যমকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়।
এর মধ্য দিয়ে বহু দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে ভিন্নমত পোষণকারীদের মুক্তভাবে মত প্রকাশ অনুমোদন করে মুক্ত সংবাদ মাধ্যম জনগণের অসন্তোষ প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে অবাধে।
এসব ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে মিডিয়া বহুমাত্রিক চিন্তাকে নিয়ে আসে জনগণের সামনে এবং এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক গাঁথুনি, যা সমাজকে অনুমোদন করে ওইসব ধারণা বেছে তুলে নিতে, যে ধারণা তাদের সবচেয়ে বেশি উপকারে আসবে।
ঠিক যেমনভাবে রক্ত আমাদের শরীরে খাঁটি অক্সিজেন সরবরাহ করে সেই অক্সিজেন ছাড়া আমাদের দেহকোষ যেমন মরে যায়, একইভাবে ‘সর্বশেষ তথ্য ও তরতাজা ধারণা’ ছাড়া একটি সমাজ মারা যায়। এসব ধারণা সামনে আসে একটি মুক্ত মিডিয়া ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যেমন একাডেমিয়া, থিংকট্যাংক, নাগরিক সমাজের সংগঠন প্রভৃতি।
একটি মুক্ত সংবাদ মাধ্যমের টিকে থাকার পূর্বশর্ত হলো কথা বলার স্বাধীনতা এবং চিন্তা করার স্বাধীনতা।
উগান্ডার সাবেক শক্তিশালী সামরিক নেতা হিসেবে পরিচিত ইদি আমিনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘কথা বলার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বক্তব্য দেয়ার পর আমি স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে পারি না’। এটাই হলো ‘কথা বলার পরের স্বাধীনতা’ যা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতায় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।
যে পরিমাণ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে, জেল দেয়া হয়েছে, দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, জোরপূর্বক সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করা হয়েছে- তাতে একটি ভয়াবহ চিত্র অঙ্কিত হয়।
যদিও এটা হলো পুরো ছবির একটি অংশমাত্র। যদি আমরা জানতে পারি যে কতজনের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে তাহলে এটা হতে পারে অনুধাবনমাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক এই ‘মিসিং’ আমাদের সমাজ ও আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রকৃতপক্ষেই একটি ক্ষতি।
সবে ডিজিটাল বিপ্লব মিডিয়ার সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ নিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটা সরকারের নিয়ন্ত্রণেরও নতুন পথ খুলে দিয়েছে।
অনেক দেশে ডিজিটাল মিডিয়ার অপব্যবহার রোধের প্রেক্ষাপটে সুদূরপ্রসারি আইন আছে। এসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে প্রধানত খবর, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাকে বিস্তৃত করতে দেয়ার পরিবর্তে তাতে বাধা দেয়ার জন্য। সরকার যেসব ডিজিটাল ও মূলধারার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে ক্রমশ জটিলতার মুখে তাদের দিকে দৃষ্টি রেখে এসব আইন কার্যকর করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এটাকে ‘তোষামোদির স্বাধীনতা’র নতুন যুগের চিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
একেবারে শুরু থেকেই তিনি কেবল ওইসব মিডিয়াকে গ্রহণ করেছেন, যারা তার প্রশংসা করে এবং অন্যদেরকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছে, ওইসব মানুষের জন্য ঘৃণাসমৃদ্ধ শব্দ ছাড়া আর কিছু বলেনি এসব মিডিয়া। যদিও তিনি সংবাদ মাধ্যমকে ঘৃণা করা প্রথম কোনো নেতা বা সরকার প্রধান নন, তবু তিনি এই প্রবণতায় সবচেয়ে শক্তিশালী গতি দিয়েছেন অবশ্যই।
বিশ্বের বিভিন্ন অংশের অনেক নেতা এখন ট্রাম্পের একান্ত অনুসরণকারী। তারা সবাই চান মিডিয়া তার প্রচলিত ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা পালন না করুক এবং তাদের কোলে লালিত হোক।
পপুলারিজম, উগ্র জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কার ও ঘৃণা সৃষ্টি করছে প্রতিদিন, যা থেকে অসহিষ্ণুতা এক নতুন উচ্চতায় উঠে যাচ্ছে। এ বিষয় এখন মুক্ত সংবাদ মাধ্যমের কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই মুক্ত মিডিয়ার মৌলিক ভূমিকার অন্যতম হলো অপ্রিয় সত্যকে সামনে আনা, উচ্চ পর্যায় ও শক্তিশালীদের প্রশ্ন করা এবং সব রকম অধিকার ও স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা।
এসব মিলে সাধারণত সমালোচনামুলক কাহিনী তৈরি করে যে, পপুলিজম, উগ্রবাদ এবং কর্তৃত্বপরায়ণতাকে ঘৃণাসহকারে পরিহার করা উচিত। অরওয়েলের ভাষায়, যদি স্বাধীনতা বলতে মোটেও কিছু বুঝায়, এর অর্থ হলো মানুষ যা শুনতে চায় না, তা মানুষের কাছে বলার অধিকার।
মিডিয়া এখন যার জন্য লড়াই করছে- এবং আরো শক্তিশালীভাবে ও ঐক্যবদ্ধভাবে করছে তা হলো, মানব সভ্যতার জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় অর্জন। তা হলো চিন্তার স্বাধীনতা এবং কথা বলার স্বাধীনতার অধিকার।
এ লড়াই এর চেয়ে কম কিছুর জন্য নয়।
( লেখক: ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)