নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি বেড়েছে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা। এতে বেড়েছে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গত ১০ দিনে জেলায় ২৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষক নামের কলঙ্ক আরিফুল ২০ ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক শিক্ষক আল আমিনের ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা প্রকাশ হওয়ার পর অভিভাবকেরা তাদের স্কুল-কলেজে পড়–য়া মেয়েদের নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্তানের সাথে নিজেরাও স্কুল-কলেজে আসছেন। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। তারা প্রায় সব ক’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে।
মেয়েকে স্কুল পাঠিয়ে একটা দুঃচিন্তা কাজ করে। কখন কি হয়। যেভাবে অঘটন ঘটছে তাতে করে আমরা খুবই চিন্তিত। আমার মেয়ের নিরাপত্তা কে দেবে? তাই বাধ্য হয়ে ঘরের কাজ ফেলে মেয়েকে নিয়ে এসেছি। যতক্ষণ তার ক্লাস চলবে ততক্ষণ আমাকে স্কুলের বারান্দায়ই কাটাতে হবে। ছুটি হলে তাকে নিয়ে বাসায় যাবো। নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে এ কথা বলেন ফতুল্লার দেলপাড়া কলেজ রোডের বাসিন্দা শেফালী আক্তার। তার মেয়ে দেলপাড়া স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। শেফালী আক্তারের মতো আরো অনেক অভিভাবকের ভিড় দেখা গেছে ওই স্কুলের বারান্দায়।
সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি অক্সফোর্ড হাইস্কুলের ২০ জনের বেশি ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করা শিক্ষক আরিফুল আটক হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় বিষয়টি। এরপর জেলার ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে আটক করা হয়েছে যার বিরুদ্ধে অন্তত ১২ শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে।
এলাকাবাসী জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল গত ৮ বছর ধরে স্কুলটিতে অঙ্ক ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা করে আসছেন। চাকরি জীবনে আরিফুল ইসলাম অসংখ্য ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করে আপত্তিকর ছবি তুলে ধর্ষণ করেছে। ছাত্রীদের কোচিং করানোর জন্য তার বাসা ছাড়াও স্কুলের পাশে বুকস গার্ডেন এলাকায় তিনি একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তার স্ত্রী, সন্তান না থাকলেও ফ্ল্যাটে তিনটি খাট ছিল বলে জানান ফ্ল্যাটের দারোয়ান। তিন দিন ধরে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো এলাকায় প্রচার হওয়ার পর গত ২৭ জুন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আরিফুলকে গণধোলাই দিয়ে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করে। রিমান্ডে এবং পরবতীতে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে আরিফুল ২০-এর অধিক ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।
সমাজকর্মী সালেহা বেগম মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধ একেবারে শেষ হয়ে গেছে। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার অভাবে আমরা আজ এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি। সন্তানকে উপযুক্ত মানুষ করার পরিবর্তে এখন এ প্লাস পাওয়ার ধান্দায় অভিভাবকেরা ব্যস্ত। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিনোদনের নামে টেলিভিশনে ক্রাইম সিন বেশি দেখানো হচ্ছে। এতে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ শহরের পালপাড়া এলাকার বাসিন্দা জেসমিন আক্তার জানান, তার মেয়ে একটি মাদরাসায় পড়ে। আরেক মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাদের নিয়ে তিনি চিন্তিত। তিনি জানান, শিক্ষক আরিফুল ও আল আমিনের ঘটনা আমাদের উদ্বেগে ফেলেছে। সে কারণে আমি মেয়েদের সাথে এসব শেয়ার করেছি। তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা নিশ্চিত করেছে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না। তবুও ভয় কাটছে না।
এদিকে শহরের মর্গ্যান বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অন্য দিনের তুলনায় গত সোমবার নারী অভিভাবকদের ভিড় দেখা গেছে। এ ছাড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও নারায়ণগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের গেটেও নারী অভিভাবকদের দেখা গেছে। একাধিক অভিভাবক জানান, তারা আতঙ্কে আছেন। সে কারণেই মেয়েদের স্কুল চলাকালীন গেটের সামনে বসে থাকেন। এতে অন্তত মেয়েরা সাহস পাবে।
রথ্যাব-১১ এর এএসপি আলেপউদ্দিন জানান, ইতোমধ্যে দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চলেছে। আমাদের গোয়েন্দা টিমও কাজ করছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, অক্সফোর্ড স্কুলে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমাদের কলিজার টুকরাদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে শিক্ষক নামের কলঙ্করা। শিক্ষকরা এখন ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত। তিনি এসব ঘটনার জন্য মায়েদের দায়ী করে বলেন, ওই মায়েরাই কিন্তু তাদের মেয়েদের প্রাইভেট ও কোচিংয়ের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। অথচ এসব শিক্ষার্থীকে তারা লাইব্রেরিতে আনেন না। নারায়ণগঞ্জে প্রত্যেক স্কুলে লাইব্রেরি আছে কিন্তু লাইব্রেরির বইগুলো জীবনে ধরা হয়নি। লাইব্রেরি০র তালাই খুলে না। তাহলে কিভাবে ভালো মানুষ গড়বো। মনে রাখতে হবে পড়ার বিকল্প কিছু নাই। আপনারা যে যাই বলেন, ফেসবুক আমাদের মধ্যে রোগের মতো দেখা দিয়েছে। ফেসবুকে যত কম থাকবো, তত বেশি ভালো থাকবো।