চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদী উত্তর ইউনিয়নের উপাদী গ্রামে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে ঝলসে দিয়েছে তার পাষণ্ড স্বামী। চাঁদপুর সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন লাকী (২২) নামের ওই গৃহবধূ।
মঙ্গলবার ভোররাতে এ নির্মম ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্থানীয় জনতা লাকীর স্বামী বিষ্ণুকে (৫০) আটক করে পুলিশে দিলেও অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
এলাকার অনেক নারী জানান, লাকীর গর্ভে মেয়েসন্তান হবে জেনেই বিষ্ণু সে সন্তান নষ্ট করার জন্য তার স্ত্রীকে চাপ দেন। আর এর জন্যই নিজের স্ত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করেছেন বলে জানান লাকীর খালার বাড়ির লোকজন।
জানা যায়, দুই বছর আগে মতলব উত্তর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের কুণ্ডল মজুমদারের মেয়ে লাকীর সঙ্গে উপাদী গ্রামের পল্লিচিকিৎসক বিষ্ণু আচার্যের বিয়ে হয়। এটি ছিল বিষ্ণুর দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের পর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ১০ মাস বয়সি সন্তানের মৃত্যু হয়। পরে পুনরায় অন্তঃসত্ত্বা হন লাকী। বিষ্ণু জানতে পারেন, তিনি মেয়েসন্তানের বাবা হতে চলেছেন।
এই নিয়ে ঘটনার আড়াই মাস আগে একই গ্রামে (উপাদী) বসবাসরত লাকীর খালা মাদবীর কাছে গিয়ে বিষ্ণু বলেন, লাকীকে যেন তার মায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এর জন্য কিছু টাকাও দিতে চান বিষ্ণু।
বিষ্ণুর বাড়িতে গিয়ে এ ঘটনার ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) রাত দেড়টায় আমি কীর্তন শুনে ঘরে আসলে সে (লাকী) দরজা খুলে দেয়। তারপর ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আমার বড় ভাই রতন ফোন দিয়ে বলে, কিরে তোর বউ কই? আমি তাকে জানাই, মনে হয় বাহিরে ঘরের কাজ করছে। সে জানায় তুই নাকি তোর বউকে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দিয়েছিস। আমি বলি, আমি তো কিছুই জানি না।’
বিষ্ণু আরো জানান, সকালে তার স্ত্রী বাড়ির পাশেই তার খালার বাড়িতে যান। সেখানেই গরম পানি বা আগুনে তার এ অবস্থা হয় বলে মনে করেন বিষ্ণু।
মাদবীর পুত্রবধূ তুলসী রানী বলেন, ‘ঘটনার দিন ভোরে লাকী ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিয়ে বাড়িতে এসে ওঠে। এ সময় তার শরীরের সামনের অংশ মুখমণ্ডল থেকে তলপেট পর্যন্ত ঝলসে যায়। মাথার চুলও হাতে উঠে আসে। পরে তাকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, মনিত মেম্বার, গ্রামপুলিশ চিত্তরঞ্জনসহ হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
লাকীর খালা মাদবী বলেন, ‘লাকী খুবই সহজ-সরল মেয়ে। আমিই তাকে বিষ্ণুর সঙ্গে বিয়ে দিই। ঘটনার দেড় মাস আগে বিষ্ণু আমাকে এসে বলে, লাকীকে তার বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে। তাকে আর ভাত খাওয়াবে না। এ সময় লাকী অন্তঃসত্ত্বা ছিল। এর জন্য ২০ হাজার টাকাও দিতে চেয়েছিল। বর্তমানে লাকীর অবস্থা ভালো না। মুখ থেকে তলপেট পর্যন্ত ঝলসে গেছে। সে বর্তমানে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’
উপাদী গ্রামের প্রাণ বল্মব বৌদ বলেন, ‘ফজর নামাজের সময় আমি মাছ ধরতে খালের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি সে (লাকী) দৌড়ে আসছে। আমাকে দেখে বলে, আমারে বাঁচান। নামাজ পড়তে আসা বহু মানুষও এ অবস্থায় তাকে দেখেছে।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লাকী বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে স্বামী কীর্তন শুনে ঘরে আসেন। পরে ঘরে দুজনেই শুয়ে পড়ি। ঘুমন্ত অবস্থায় ভোররাতে শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু করলে ডাক-চিৎকার দেই। এ সময় আমার স্বামী আমার পাশে ছিলেন। কিন্তু অন্য কেউ এগিয়ে আসেননি। সবাই গভীর ঘুমে ছিলেন। পরে উপায় না পেয়ে দৌড়ে আমার খালার বাড়িতে চলে যাই।’
লাকীর বিষয়টি নিয়ে চাঁদপুর জেনালের হাসপাতালের চিকিৎসক মাহমুদুন নবী মাসুম জানান, তিনি (লাকী) এই মুহূর্তে সঠিক কথা বলতে পারছেন না। তার শরীর ঠিক কী কারণে ঝলসে গেছে, তা বৃহস্পতিবার ফরেনসিক রিপোর্টে বোঝা যাবে।
ঘটনার দিন বুধবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকার লোকজন বিষ্ণুকে আটক করে মতলব দক্ষিণ থানা পুলিশকে খবর দেয়। পরে থানার এসআই মোরশেদুল আলম ভূঁইয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়।
এ বিষয়ে এসআই মোরশেদুল আলম বলেন, ‘রোগীর পক্ষের কোনো লোক না থাকায় এবং বিষ্ণুর বাড়ির লোকদের কথার ভিত্তিতে তাকে (বিষ্ণু) ছেড়ে দিয়েছি। তবে লিখিত কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাঁদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আমির জাফর বলেন, ‘ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের গাফিলতি থাকলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’