উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা রাজধানী দিল্লিতে মহামস্তানি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ তারা ধর্মস্হান জ্বালিয়ে দিচ্ছে৷ ছাই করে দিচ্ছে৷ পূর্ব দিল্লির সেন্ট সেবিয়ান চার্চ৷ খ্রিস্ট ধর্মসম্প্রদায়ের পবিত্র এই ধর্মস্হানকে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করেছে তারা৷ এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা দিলশাদ রোডে৷ ঘটনাটি সেখানেই থেমে যায়নি৷ আবার তারা সংখ্যালঘু ধর্মস্হান আক্রমণ করল৷ এবারে ঘটনা ঘটাল দিল্লিরই ওখলার জসোলায়৷ উগ্ররা পাথর ছুঁড়তে থাকে৷ তখন চার্চে প্রার্থনা চলছিল৷ সেই অবস্হায় ওরা পাথর ছোঁড়ে৷ আওয়ার লেডি অফ ফতেমা নামে চার্চের জানলার কাচ ভেঙে যায়৷ এই সিরো-মালাবার ক্যাথলিক চার্চে যাঁরা প্রার্থনায় আসেন তারা মালয়ালমভাষী এবং এই দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ৷ তারা আক্রাম্ত হলেন প্রার্থনা চলাকালীন৷ পুলিসকে জানানো হল৷ পুলিশ কাউকে আটক করেনি৷ এখনও করেনি৷ পরে করবে কিনা জানা যাচ্ছে না৷
এই ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে সেন্ট সেবিয়ান চার্চ ভস্মীভূত হয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের দ্বারা৷ রাজধানীর বুকে অবলীলায় এই সব ঘটছে এখন৷ ভোটের আগে দিল্লি সম্ভবত উগ্র হিন্দুত্বের গবেষণাগারে পর্যবসিত হতে চলেছে৷ এক্ষেত্রে সত্যি-সত্যিই বি জে পি-র সুশাসনের চেহারা কী দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার৷ উগ্র হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ কিন্তু কোনো সুশাসনের চিহ্ন বহন করে না৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লির ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেয় দেখা যাক৷ অবশ্য এইভাবে পরপর চার্চ আক্রাম্ত হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক বিবৃতিতে বলেছেন, দিলশাদ গার্ডেনের ঘটনায় বিশেষ তদম্তকারী দল গড়ে দেওয়া হয়েছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা সরকারের অগ্রাধিকার৷ বটেই তো৷ কিন্তু আর এস এস বা ওই জাতীয় হিন্দুত্ববাদী উগ্র সংগঠন মনে করে খ্রিস্টানদের সঙ্গে তাদের একটাই সম্বন্ধ আর তা হল মূলত সঙঘর্ষমূলক সম্বন্ধ৷
এই সংঘর্ষমূলক সম্বন্ধকে প্রীতিপ্রদ করে তুলতে চাইছে আর এস এস তার ধর্মাম্তরকরণ আদর্শের প্রবল সক্রিয়তার মাধ্যমে৷ অন্য ধর্মের মানুষকে ভয় বা লোভ দেখিয়ে হিন্দুধর্মে ধর্মাম্তরিত করা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙেঘর এক বিশেষ আদর্শ– এ ব্যাপারে এই সঙঘ বা আর এস এস প্রচণ্ড উগ্র্ব তারই রাজনৈতিক আঙ্গিক হল বি জে পি৷ একজন উগ্র পাদ্রি যেমন উগ্র৷ একজন উগ্র মোল্লা বা একজন উগ্র তালিবান যেমন উগ্র৷ একজন উগ্র আর এস এস তেমনই উগ্র৷ বরং ভারতকে এই সংঘটন রামরাষ্ট্র বানাতে বদ্ধপরিকর বলে সে এই দেশে তার আচরণ উগ্রতর, হয়ে উঠেছে দিনকে দিন, এখন সে দল মোদিজির মতো মহানায়ককে তখতে বসিয়ে দিতে পেরে বিশেষ আহ্লাদিত৷ গরিব মুসলমান ও গরিব খ্রিস্টানকে হিন্দুধর্মে জোর করে কনভার্ট বা হিদায়ত করবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে৷ আগ্রার ঘটনা সবিশেষ নজির৷
আমারই ভুল হয়েছে মোদিজিকে আমি ভার্চুয়াস প্রধানমন্ত্রী বা পুণ্যাত্মা মনে করেছি৷ তাকে আমি অটলজির উত্তরসূরি ভেবে বসেছি৷ ভেবেছি তার জমানায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ জানমালের নিরাপত্তা পাবে হয়ত বা! তবে কখনও নিঃসংশয় হতে পারিনি৷ ভয় করেছে৷ ফের ভেবেছি, না মোদিজি আসলে হয়ত ধর্মাশোক্ব গীতার আসল মর্মটি হয়ত এই মানুষটি বোঝেন৷ যিনি রাষ্ট্রপ্রধানদের উপহার দেবেন বলে পকেটে করে গীতা নিয়ে বিশ্বঅভিমুখী হয়েছেন, তিনি নিশ্চয় মহাভারতের মর্মার্থ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের মতো করে অবশ্যই বুঝে থাকবেন৷ ওবামাকে গীতা উপহার তো হতে পারে ভারতে গৃহযুদ্ধ বাধাবার আগাম সঙ্কেত৷ মহাভারতে জ্ঞাতি-নিধন৷ মোদিজির গীতায় রয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়কে, মুসলিম ও খ্রিস্টান ভাইকে নিধন করার বার্তা৷ তাই কি? না, না৷ এ হতেই পারে না মোদিজি! আপনাকে আমি একজন ধর্মপুত্র ভেবেছি, স্বয়ংধর্ম ভেবেছি৷ মহাভারতের মহান বৈরাগ্য-অনুভূতি এবং সুমহান মহাবিষাদ আপনার আত্মাকে বিধৌত করুক হে নরেন্দ্র!
কথা তো সত্য যে, আর এস এস রাজ্যে রাজ্যে ধর্মাম্তরকরণ চালিয়ে যাচ্ছে, তার এই উন্মাদনার কোনও অম্ত নাই৷ শুনেছি আপনার জীবনবীক্ষা এই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙেঘর দ্বারাই পরিমিত৷ এই অবস্হায় আপনার নামের সঙ্গে প্রলিপ্ত তকমা ‘বিকাশপুরুষ’– তার কী হবে! সেটাকে কি আপনি গায়ের ময়লার মতো ত্যাগ করবেন?
কংগ্রেসের এক নেতা একশ্লেষ সহযোগে সম্প্রতি বলেছেন, ‘মুসলিমদের রমজান মাসের রোজার সময় খেতে বাধ্য করা হয়েছে৷ সানিয়া মির্জাকে পাকিস্তানের বউ বলা হয়েছে৷ এই কি আমাদের বহু প্রতীক্ষিত ‘আচ্ছে দিন!’
হে নরেন্দ্র! আপনার আচরণ সর্বদা আমরা বুঝে উঠতেই পারি না৷ আপনি বৈদাম্তিক সঙ্কীর্ণ ধর্মবেত্তা নাকি প্রকৃত মানবধর্মের সেবক? আপনি কি গোঁড়া এবং হিংস্র? আপনি কি খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের ঘৃণা করেন? আচ্ছা বলুন তো স্যার, সাধ্বী নিরঞ্জনা জ্যোতি ঠিক কাদের হারামজাদে বলে চরম বিদ্বেষ ছড়ালেন? হারামজাদে শব্দটির বাংলা তরজমা হল, হারামির বাচ্চা অর্থাৎ জারজ৷ আপনার রাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কেমন কথা স্যার! এঁরাই কিন্তু স্যার সম্প্রদায়িকতার বিষকর্দমে পুঁতে আপনার পুণ্যাত্মা ইমেজ ধ্বংস করে দেবেন এবং আপনার রাজনৈতিক কেরিয়ারও শেষ হবে৷
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আপনি আচ্ছে দিন আনতে ব্যর্থ হবেনই৷ এবং তখন গদি বাঁচাতে ভারতবর্ষে দাঙ্গা বাধাবেন৷ আমি কিন্তু স্যার, ওই সব পর্যবেক্ষকের কথায় মোটেও কান দিচ্ছি না৷ আপনাকে বৃহদংশের ভোটাররাই আচ্ছে দিন আসবে এমন আশায় বুক বেঁধে ভোট দিয়েছেন, মুসলিম ভোটেরও একাংশ আপনি পেয়েছেন স্যার! আপনি যদি খ্রিস্টানদের একটি ভোটও পেয়ে থাকেন, তা হলেও আপনাকে খ্রিস্টানদের জীবন-নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে৷ যদি খ্রিস্টান ভোটের একটিও না পেয়ে থাকেন, তা হলেও খ্রিস্টানের জানমাল রক্ষা করা আপনার কর্তব্য স্যার, এটাই রাজধর্ম৷ আর স্যার বাই দি বাই, ওবামাকে গীতা প্রেজেন্ট করাটা তো শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্টকে উপহার দেওয়াই নয়, সঙ্গে-সঙ্গে একজন শাম্তি নোবেল প্রাপককেও দেওয়া হে পুণ্যাত্মা, হে ধর্ম!
আসুন আজকের এই মুহূর্তে, মহাভারতের একটি মহৎ বাক্য স্মরণ করি৷ মহাভারতের শাম্তিপর্বের ১৭৪ অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে, ‘ধর্মের অসংখ্য দ্বার৷ যে কোনও প্রকারে হউক, ধর্মের অনুষ্ঠান করিনে উহা কদাপি নিষ্ফল হয় না৷’
রমজানের রোজা ধর্মেরই অনুষ্ঠান হে নরেন্দ্র৷ ১৭৪ অধ্যায়ে উক্ত কথাটিকে সম্বল করে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘ধর্ম এক বস্তু বটে, কিন্তু তাহার নিকটে পৌঁছিবার অনেক পথ আছে– কৃষ্ণভক্ত এবং খ্রীষ্টীয়ান উভয়েই সেখানে পৌঁছিতে পারে৷’ কিন্তু মনে আছে তো স্যার, এক খ্রিস্টিয়ান স্ত্রীর চোখের সামনে তার স্বামী ও পুত্রকে জ্যাম্ত পুড়িয়ে মেরেছিল ধর্মোন্মাদরা৷ সেই নারী কিন্তু ওই উন্মাদদের ক্ষমা করে দিয়েছেন৷ আপনি স্যার এমনই এক দেশের প্রধানমন্ত্রী! কী নিষ্করুণ এই দেশ!