বিদায়ী বছরটিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি৷ ফলে বিনিয়োগ বাড়েনি, তবে বেড়েছে বেকারত্ব৷ জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার না কমলেও অর্থনৈতিক সেক্টরে বড় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷
বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেও অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টে ধস নেমেছে৷ বেড়েছে দুর্নীতি৷ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি গেল দুই বছর অনেক কমে গেছে৷ তারপরও সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক আপাতদৃষ্টিতে ভালো থাকলেও, তার সুফল কিন্তু জনগণ পাচ্ছে না৷ শ্রমজীবী মানুষেরাই চালিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা৷ ডয়চে ভেলের কাছে বিদায়ী বছরটির অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ৷
রিক্সা চালক রফিক উদ্দিনের কাছে মনে হয়েছে, গেল বছরের অর্থনীতি বেশ ভালোই গেছে৷ তাঁর যুক্তি, হরতাল-অবরোধ বা রাজনৈতিক সহিংসতা তেমন ছিল না৷ তাই প্রতিদিনই তিনি রিক্সা চালাতে পেরেছেন৷ যা আয়-রোজগার হয়, তা দিয়ে ভালোই দিন চলে যাচ্ছে তার৷ কিন্তু হরতাল অবরোধ বা সহিংসতা হলে তার আয় কমে যায়, সংসার চালাতে কষ্ট হয়৷ জিনিসপত্রের দাম বিদায়ী বছরটিতে খুব একটা বাড়েনি৷ তাই সব মিলিয়ে বছরটিকে ভালো বলেই মনে করেন রফিক উদ্দিন৷ তাঁর দাবি, সব কিছুর আগে দরকার রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন৷ তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে, অর্থনীতিও ভালো থাকবে৷
সর্বশেষ গত জুনে বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে (ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০১৪) বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেড়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার৷ ২০১২ সালে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১২৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার৷ ২০১৩ সালে সম্পূর্ণ নতুন বিনিয়োগ এসেছে ৫৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশেরও বেশি৷
পলিসি রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৪ সালটি রাজনৈতিকভাবে শান্তিপূর্ণই ছিল৷ তাই সবার ধারণা ছিল এবার বিনিয়োগ বাড়বে৷ কিন্তু বছর শেষে যা দেখা যাচ্ছে যে, বিনিয়োগ সেভাবে বাড়েনি৷ ২০১৩ সালে বৃদ্ধির হার যা ছিল, ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতি৷ আসলে সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক কোনো কার্যক্রম নেয়া হয়নি৷ ফলে যেটা হচ্ছে, এক্সপোর্ট প্রবৃদ্ধি প্রথম ৫ মাসে দেখা গেল ১ শতাংশের মতো, যা আগের বছর ছিল ১২/১৩ শতাংশ৷ কিন্তু বছরশেষে এক্সপোর্ট প্রবৃদ্ধি ১২/১৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়া কঠিন৷ কারণ গার্মেন্টস সেক্টরের অনেক ক্রেতা অন্য দেশে চলে গেছেন৷ আমাদের যেসব উদ্যোগ আছে তাতে তারা হয়ত আবার ফিরে আসবেন৷ ততদিনে কিন্তু আমাদের এক্সপোর্ট প্রবৃদ্ধি গত বছরগুলোর তুলনায় অনেক কমে যেতে পারে৷”
পলিসি রিসার্স ইনষ্টিটিউটের এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ শিক্ষিত মানুষ চাকরির বাজারে আসছে৷ এ সব শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা না করা গেলে শিক্ষিত বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই যাবে৷ আবার বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি অনেক কমে গেছে৷ এ বছর ৪ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে পাঠানো যায়নি৷ আগের বছরও সংখ্যা একই ছিল৷ কিন্তু ২০১২ সালে বা তার আগে বিদেশে জনশক্তি গেছে ৬ থেকে ৮ লাখের মতো৷ ফলে দেশের চাকরির বাজারে এই মানুষগুলো ভিড় করছেন৷ ফলে চাকরির বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর৷
গত ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে প্রবাসী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করছে৷ গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৫৭ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, মাথাপিছু আয় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে, ডাবল ডিজিট থেকে মুদ্রাস্ফীতি আবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে প্রায় এক কোটি৷ তিনি বলেন, এ সময়ে রপ্তানি আয় তিন গুণ বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন থেকে ৩০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে৷ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে৷ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের কোটা ছুঁয়ে এখন ২২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে৷ শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি শিল্পায়িত মধ্য আয়ের ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা৷ আর ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া৷ সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার৷
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম গত মাসে একটি পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রবৃদ্ধি ভালো হলে সরকারের রাজস্ব আহরণের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়৷ তার ফলে সরকার বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে রেখেও, দারিদ্র্যবিমোচন সংক্রান্ত যেসব সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত, সেক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিতে পারেন৷ ভারতের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু সূচকে তারা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে৷ তবুও প্রবৃদ্ধি, একটা পূর্বশর্ত হচ্ছে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়ন৷ এক্ষেত্রে আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেই চ্যালেঞ্জগুলো অ্যাড্রেস করার জন্য আমার মনে হয় নীতিনির্ধারণকে খুব বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া উচিত৷”