ঢাকা: ৯৩টি পণ্যের মান পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বিএসটিআইকে নির্দেশ আদালতের নির্দেশের পরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেজাল ও নিম্নমানের ৫২টি পণ্যের মধ্যে কোনো একটি পণ্যও জব্দ না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতি নাখোশ হয়েছেন হাইকোর্ট। এ কারণে আদালত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব করেছেন। আগামী ১৬ জুন তাকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে আদালতের আদেশ না মানার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করায় তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে সম্প্রতি বিএসটিআই ৪০৬টি খাদ্য পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। এক্ষত্রে বাকি যে ৯৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেনি সেই ৯৩টি পণ্যের মান পরীক্ষার প্রতিবেদন আগামী ১৬ জুনের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বিএসটিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নিম্নমানের ৫২টি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বাজারজাত করতে চায় তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের পণ্য বিএসটিআই থেকে পুনঃ পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। এই পুনঃ পরীক্ষার প্রতিবেদন যত দ্রুত সম্ভব সর্বোচ্চ ১৩ জুনের মধ্যে প্রকাশ করতে বিএসটিআই’র প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস)-এর করা এক রিট আবেদনে এ আদেশ দেওয়া হয়।
রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ফরিদুল ইসলাম, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন কামরুজ্জামান কচি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। এছাড়া এসিআই’র পক্ষে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণ গ্রুপের পক্ষে ছিলেন এম কে রহমান, সান চিপস (কাশেম গ্রুপ) এর পক্ষে ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলম এবং বাঘাবাড়ি ঘি কম্পানির পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন মেহেদী।
আদালত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, আপনারা হাইকোর্টকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন? আপনারা আমাদের আদেশ কেন বাস্তবায়ন করেননি? আজ পর্যন্ত একটি মসলার প্যাকেটও জব্দ করেননি। সারা বাংলাদেশ থেকে একটি প্যাকেটও জব্দ করতে পারলেন না? হাইকোর্টের আদেশ দেওয়ার পরও আপনার কার্যালয়ের পাশের দোকান থেকে ১৭ জন মিলেও একটি মসলার প্যাকেট জব্দ করার সাহস নেই! এত ভয় কেন? বড় বড় কম্পানিকে ভয় পাচ্ছেন? তাহলে চাকরি করার দরকার কি? ঘরে গিয়ে রান্নাবান্না করুন। ব্যাংকে যেয়ে কেরানির চাকরি নিন। বসে বসে টাকা গুনবেন, টাকার হিসাব রাখবেন।
আদালত বলেন, আমাদের আদেশ পছন্দ না হলে আপিল বিভাগে যেতে পারেন। কিন্তু তা না করে আদেশ মানবেন না, তা হবে না। আমরা আদেশ দিয়েছি, তা মানতে হবে। এনিয়ে কোনো আপোষ নয়।
আদালত বলেন, আপনাদের শো’ডাউন করতে সমস্যা হচ্ছে না, টিভি ক্যামেরা নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তব্য দিতে পারেন, কিন্তু একটি পণ্যও জব্দ করতে পারলেন না।
এসময় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, আমরা সকল জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছি। ৫২টি মামলা করেছি। আর সারাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেন পাইনি। তাই এ মুহূর্তে আদালতে জানাতে পারিনি।
এই বক্তব্যে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ব্যবস্থা নিতে অন্যদের কাছে চিঠি দিতে আপনাদের কে বলেছে? আপনাদের প্রতি আমরা নির্দেশ দিলাম। আপনারা নিজেরা দায়িত্ব পালন না করে অন্যদের চিঠি দেন। আবার বলছেন, এখনও সারাদেশ থেকে প্রতিবেদন আসেনি। উল্টাপাল্টা বলবে না। হাইকোর্টকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন? আপনারা সোজা পথে যান না কেন? আপনারা যা করেছেন তা আই ওয়াশ মাত্র।
অপরদিকে নিম্নমানের ৫২টি পণ্য জব্দের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নেওয়া পদক্ষেপ আদালতে তুলে ধরেন তার আইনজীবী। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে নিম্নমানের পণ্য জব্দের তথ্য তুলে ধরেন। এসময় আদালত তাদের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, আমার প্রত্যাশা করি আপনারা আপনাদের কাজ অব্যাহত রাখবেন।
হাইকোর্ট গত ১২ মে এক আদেশে নিম্নমানের ৫২টি পণ্য বিক্রি বন্ধ ও বাজার থেকে জব্দ করতে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ বাস্তবায়ন বিষয়ে গতকাল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। এই নির্দেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে। এরমধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রশংসা করেন।
এসিআই লবণ এসিআই লবণ কর্তৃপক্ষের পক্ষে গত ১২ মে’র আদেশ সংশোধন চেয়ে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ফ্যাক্টরিতে নির্ধারিত তাপমাত্রায় লবণ থাকে। কিন্তু বাইরে দোকানে ও খোলাবাজারে আসার পর তা নির্ধারিত তাপমাত্রায় না থাকায় হয়তো গুণগত মান কমে গেছে।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত এসিআই লবণের একটি প্যাকেট দেখিয়ে বলেন, লবণের প্যাকেটের ওপর কি লেখা আছে কত তাপমাত্রায় তা রাখতে হবে? কিন্তু প্যাকেটেতো তা লেখা নেই যে মানুষ ঘরে কত তাপমাত্রায় রাখবে।
আদালত বলেন, লবণ কেন নষ্ট হবে? আমরা সকলেই লবণ রাখি রান্না ঘরে। রান্না ঘর সবসময় গরম থাকে। আর গরমে যদি লবণের মান নষ্ট হয় তবে তা প্যাকেটে লিখে দেননি কেন? এটা লেখা থাকলে তো মানুষ লবণ রান্না ঘরে না রেখে ফ্রিজে রাখতো।
এসময় ব্যারিস্টার রোকন বলেন, সব লবণেতো সমস্যা পায়নি। একটি নির্দিষ্ট ব্যাচের লবণে সমস্যা পেয়েছে। বাকি ব্যাচের লবণের বিষয়ে আদেশ চাচ্ছি।
জবাবে আদালত বলেন, মানুষ কি ব্যাচ থেকে লবণ কেনে? আপনাদের লবণের প্যাকেটের গায়ে বড় করে লেখা আছে একশ ভাগ পিওর। আবার লেখা আছে ২ বছরের মেয়াদ। কিন্তু উৎপাদনের তারিখ লেখা নেই। থাকলেও তা দেখতে সুপারসনিক চোখ লাগবে। আপনি ১০ বছর পরেও যদি দেখেন তখনও ওই দুই বছর। আর দুই বছরের মেয়াদ আজীবনেও শেষ হবে না। মানুষকে কত রকম ঠকানো যায় তার সব আছে।
প্রাণ কম্পানির প্রশংসা
প্রাণ কম্পানির পক্ষে আইনজীবী এম কে রহমান বলেন, বিএসটিআই আমার তিনটি পণ্যের বিষয়ে আপত্তি করেছে। কিন্তু আমার সব পণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই ওই তিনটি পণ্যের নির্ধারিত ব্যাচ বাদে সব ছাড় চাচ্ছি।
আদালত বলেন, প্রাণতো অনেক বড় কম্পানি। সিঙ্গাপুরে যেয়ে প্রাণ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। প্রাণ আমাদের গর্ব। সেই প্রাণের পণ্য যদি আমাদের দেশে এই রকম হয় তাহলে …।
এসময় এম কে রহমান বলেন, বিশ্বের একশ ৪২টি দেশে প্রাণের পণ্য রপ্তানি হয়। আদালতের আদেশের পর গোটা বিশ্বে আমাদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারনা গেছে। তাই তিনটি পণ্য বাদে বাকিগুলোর বিষয়ে আদেশ সংশোধন চাচ্ছি।
এসময় আদালত বলেন, বিএসটিআই থেকে নতুন করে পুনঃ পরীক্ষার প্রতিবেদন নিন। ছাড়পত্র পেলেই কেবল বাজারে ছাড়বেন।