ঢাকা: ভারত শাসনের ভার ফের নরেন্দ্র মোদির হাতেই উঠছে। প্রতিবেশী দেশ এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে মিল থাকার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও দলগুলোর কাছে ভারতের নির্বাচন বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে রাজনীতিতে প্রচলিত ছিল। গতবার (২০১৪) যখন বিজেপি ক্ষমতায় আসে তখন বিএনপি উচ্ছ্বাসও দেখিয়েছিল। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
মোটাদাগে মোদির ৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালোই ছিল বলে দেখা গেছে। এই সম্পর্ক একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিএনপির নেতারাও মনে করেন, বিজেপির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গত ৫ বছরে ভালো হয়নি। অতীতে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির ‘ভালো সম্পর্ক’ ধরে রাখা যায়নি। আর তাই মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের জয়ে আগেরবারের মতো উচ্ছ্বসিত নয় বিএনপি। প্রতিক্রিয়া প্রকাশে এবার অনেকটাই সতর্ক ও সংযত দলটি।
আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলে ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে এবার বিজেপি জোট ৩৫০ আসনে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে কংগ্রেস জোট পাচ্ছে ৯০টি আসন। নিশ্চিত বিজয়ের পথই আছে বিজেপি। ভারতের এবারের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কথা বলেনি। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা বাকি।
বিএনপির রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক খারাপ না। এবার কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও এই সম্পর্কের খুব হেরফের হতো না। বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কও ভালোই হবে। বিএনপির সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিজেপির সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক নেই। তবে ক্ষমতাসীন দলের (আ.লীগ) সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ়। এই পাঁচ বছরে বিএনপি বিজেপির সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা তেমন তৎপরও ছিলেন না। আর বিজেপিও হয়তো আগ্রহ দেখায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিজেপির পুনরায় ক্ষমতায় আসাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্পর্কে হয়তো তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে ভারতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, যেমন আসামে বসবাসরত মুসলিমদের যে বিতাড়নের চেষ্টা হচ্ছে সেগুলোতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এবার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন এমাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে বাঙালিদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্কে কোনো কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। বরং নদীর পানি নিয়ে সংকট দুই দেশে তার কোনো ফয়সালা হতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে সু-সম্পর্কই থাকবে। যা ছিল তার থেকে খারাপ হবে না।’
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কংগ্রেসের পরাজয়ে আভাস পেয়ে বেশ উৎফুল্লই ছিল বিএনপি। বিএনপি তখন মনে করেছিল, ভারতের কংগ্রেস সরকারের সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গে শেখ হাসিনা পরিবারেরও সু-সম্পর্ক রয়েছে। সেদিক থেকে বিজেপির ক্ষমতায় আসাতে বিএনপি বেশ খুশিই হয়েছিল। দলটির ধারণা ছিল, বিজেপি কংগ্রেসের মতো একতরফাভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে না।
গতবার ভোটের পর বিজেপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণার আগেই বিএনপি নরেন্দ্র মোদি ও দলটির সভাপতি অমিত শাহকে অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বার্তা নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে উপস্থিত হন চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান। এটি লেখার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন বিএনপির পররাষ্ট্র বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা সমশের মবিন চৌধুরীর (এখন দল পরিবর্তন করে বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন) ওপর। তখন বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নানা কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিজেপির জয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
২০১৫ সালে আন্দোলনের সময় যখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে আটকে ছিলেন, তখন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ তাঁকে ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। যদিও এর দুদিন পর অমিত শাহ জানান, তিনি খালেদা জিয়াকে ফোন করেননি। এই ঘটনায় বিএনপিতে রাজনীতিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির তেমন কোনো পরিবর্তন নেই জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘গত নির্বাচনে বাংলাদেশের ‘জনগণ’ নরেন্দ্র মোদির প্রতি আকৃষ্ট ছিল এ কারণে যে মোদি জয়লাভ করলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুলবে। যেহেতু একটা ধারণা ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য বেশি। তবে মোদি নির্বাচিত হওয়ার পরে ভারতের রাজনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি কোনোটাই যে পরিবর্তনশীল না, এটা প্রমাণিত হয়েছে গত পাঁচ বছরে। আর এই পাঁচ বছরে বিএনপির সঙ্গে বিজেপির তেমন কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, এখানে দলের বা ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কটা মুখ্য না। দুই দেশের সম্পর্কটাই মূল।’
গতবারের উচ্ছ্বাস প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা একটা জিনিস দেখে আসছি বা ধারণা করা হয়ে থাকে, ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের প্রশ্নে কোনো ব্যক্তি বা দলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। সে কারণেই গতবারের উচ্ছ্বাসটা জনগণের ছিল। স্বাভাবিক কারণেই এবার আর সেটা (উচ্ছ্বাসটা) নাই।’ বিজেপির সঙ্গে গত পাঁচ বছরে বিএনপি সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা করেছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা সরকারে থাকে তারাও করে, বিরোধী দলে যারা থাকে তারাও সে চেষ্টা করে। ভারতের নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশার ব্যাপারে বলেন, ভারতে গণতন্ত্র আছে কিন্তু তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। এটা ভারতের রাজনীতিবিদ, সরকার ও জনগণ কীভাবে মূল্যায়ন করবে, সেটা তাদের বিষয়।
বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থী রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমাদের কাছে বিষয়টা হচ্ছে যে-ই ক্ষমতায় আসুক সেটা বড় ব্যাপার নয়। তারা দু-দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে নজর দেবে এবং যেসব অমীমাংসিত বিষয়গুলো আছে, যেমন তিস্তার পানি, সীমান্তে হত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের নিয়ে টানাপোড়েন আছে ভারত সেখানে নজর দেবে।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত হস্তক্ষেপ করেছে, অভিযোগ করে রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এমন পররাষ্ট্রনীতি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। বাইরের শক্তির সঙ্গে আমাদের আপস করে থাকতে হয়। বাংলাদেশে “ভারতবিরোধী” মনোভাব রয়েছে। নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি বিশেষ দলকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে যেন আর বিরোধী না করে তোলে।’ তিনি আশা করেন, এবার ভারত মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগী হবে। এই পাঁচ বছরে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি না? জানতে চাইলে বিএনপির নেত্রী বলেন, ‘আমি তা মনে করি না। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে আমরা সব দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।’