হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ ভুট্টা আবাদে প্রতি বছরই দেশের শীর্ষে থাকে সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলা। তিস্তা ও ধরলা নদীর চরসহ এই জেলার মাটি ও আবহাওয়া ভাল হওয়ায় ভুট্টা আবাদ বেশি হয় বলে কৃষকেরা ভুট্টা চাষে বেশ আগ্রহী। বিগত বছর গুলোতে ভুট্টার দাম ভাল পাওয়ায় এবছরও জেলার অধিকাংশ কৃষক ভুট্টা চাষ করেছেন।
তবে এ বছর ভুট্টার ভাল আবাদ হলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চাষিদের এখন মাথায় হাত। তারা ভুট্টা চাষ করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অনেক কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভুট্টা চাষ করে ভাল ফলন পেলেও দেখছে না লাভের মুখ।
কৃষকরা বলছেন, লাভ তো দূরের কথা, এখন ঋণ আর সুদের টাকা তারা পরিশোধ করতে দিশেহারা।
জানা গেছে, লালমনিরহাটে প্রতি বছর ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে এই ভুট্টা চাষের সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড় লাখ কৃষক। ভুট্টা কেনাবেচা, বাছাই, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণসহ নানা কাজে জড়িত আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। কিন্তু একটি চক্র কারসাজি করে নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করায় মাড়াই মৌসুমে আশানুরূপ দাম পান না কৃষকরা। আর যখন দাম বাড়ে, তখন কৃষকের হাতে আর ভুট্টা থাকে না। ফলে লাভবান হন কতিপয় ব্যবসায়ী। বাজার দখলে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। তারা নানা অজুহাতে কম দামে ভুট্টা কিনছেন। ফলে দাম না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন কৃষক।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় তাদের উৎপাদিত ফসলের লোকসানের পর ভুট্টা চাষে কিছু লাভের আশা ছিল। সেই ভুট্টাতেও তারা এ বছর সঠিক দাম পাচ্ছেন না। গত বছর এ সময়ে ৭০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা মণ দরে ভুট্টা বিক্রি হলেও এ বছর চলতি মৌসুমের শুরুতে লালমনিরহাট জেলায় ৫৩০ টাকা থেকে ৫৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
তারা বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ভুট্টার ভাল ফলন হয়েছে। আবহাওয়া ভাল থাকায় তেমন ক্ষতিও হয়নি ক্ষেতের। তবে ভাল ফলন হলেও বাজারে দাম নেই ভুট্টার। এ রকম দাম যদি আরও কয়দিন থাকে তাহলে পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের।
কৃষকেরা আরও জানান, প্রতি বিঘায় ভুট্টা চাষে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। জমি বর্গা বা ইজারা নিয়ে চাষ করলে খরচ আরও ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। প্রতি বিঘায় গড়ে ৩০ মণ ভুট্টা পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় পাওয়া যাচ্ছে মাত্র সাড়ে ১৬ হাজার টাকা।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত ১০ বছরে এ জেলায় ভুট্টার আবাদ নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের ভুট্টাচাষি কাবদালী জানান, কিছুদিন আগেও ভুট্টার দাম কিছুটা থাকলেও এখন তা আর নেই। বর্তমান বাজারে মিটার পাশ ভুট্টা ৫৩০ টাকা থেকে ৫৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দামে ভুট্টা বিক্রি করলে কৃষকদের লাভ হবে না। বরং লোকসান গুণতে হবে অনেক টাকা।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও শীর্ষ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি ভুট্টার বাজার। তারা সবাই এক হয়ে বাজার দর ঠিক করেন। এরপর ওই দরে ভুট্টা কিনে গুদামজাত করেন। কৃষক বাধ্য হয়েই কম দামে ভুট্টা বিক্রি করেন। কৃষকের হাত ছাড়া হলেই মণ প্রতি দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যায়।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিধূ ভূষন রায় জানান, এ বছর লালমনিরহাটে লক্ষমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে।
ভুট্টার দাম কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। উৎপাদিত ফসল কৃষক ঘরে রাখতেও পারে না। অভাবের সংসারে টাকার প্রয়োজনে তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। এ জন্যই ভুট্টার দাম কমে গেছে। যে সব ব্যবসায়ী ভুট্টা কিনে রাখছেন তারা ঠিকই লাভবান হবেন।