নাগরিক শোকসভায় বক্তারা ‘মাহফুজ উল্লাহ শেষ পর্যন্ত সত্যকে সত্য বলে গেছেন’

Slider রাজনীতি


ঢাকা: মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন একজন নির্ভিক সাংবাদিক। অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন অকৃপণভাবে। সকল ভয় ভীতির উর্ধে মাহফুজ উল্লাহ সব সময় সকলের ঐক্যের কথাই বলে গেছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মধ্যে। তাঁর পছন্দের দল ছিল, মত ছিল কিন্তু তিনি অন্যের মতের ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। আজ জাতীয় প্রেসকাবে বরেণ্য সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ স্মরণে আয়োজিত এক নাগরিক শোকসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় সকাল ১১টায় এ শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক এ শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। এছাড়াও উপস্থিতি ছিলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা। মাহফুজ উল্লাহ গত ২৭ শে এপ্রিল থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, মাহফুজ উল্লাহর পরিচয় আমার অনেকদিনের। তার ভাইও আমার অনুজ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমি প্রথম যাকে খুঁজেছি তিনি হলেন মাহবুব উল্লাহ। তারা দুই ভাই ছিল এক বৃন্তে দুই ফুলের মত। কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আজ থাকলে আমাদের সাহস দিতে পারতেন। আল্লাহ মাহফুজ উল্লাহর মত একজন গুনী মানুষকে দিয়েছেন এজন্য আমাদের শুকরিয়া করতে হবে। তার মূল অবধান হচ্ছে পরিবেশ সাংবাদিকতা। পারিবেশ সাংবাদিকতায় অনেকদিন অমর হয়ে থাকবেন। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট লেখক। তার লেখায় অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে টকশোতে আনার। তিনি যুক্তিতে কথা বলতেন। যারা তার সঙ্গে মতপার্থক্য ছিলেন তারাও আজ এখানে এসেছেন। তার সঙ্গে আমারও মতপার্থক্য ছিলো তবুও তার সঙ্গে ঝগড়া করা যেত তিনি তা খুব সহজে হাসি দিয়ে গ্রহণ করতেন।

বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মাহফুজ উল্লাহ এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন এটা ভাবতেও পারিনি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যপার। চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে একটা সভায় এসেছিলেন। সেখানে তিনি বিএনপির কঠিন সমালোচনা করেছিলেন। এটাই ছিল তার বড় গুন, তিনি সত্যকে সত্য বলতেন।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, মাহফুজ উল্লাহকে আমি জানি ছাত্র অবস্থা থেকে। তিনি অনেক লিখেছেন, এরমধ্যে একটি লেখায় তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তা হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, মাহমুজ উল্লাহ আমাদের মাঝে চিরজীবী হয়ে থাকবেন। আমি মাহফুজ উল্লাহকে কাছ থেকে দেখেছি। এখানে আজ বিভিন্ন মতের মানুষ এসেছেন, এটা একটা ঐক্য। এটাই চেয়েছেন মাহমুজ উল্লাহ। সব মহলের লোক আজ এখানে এসেছেন, ওনাকে সম্মান জানাতে এসেছে কারণ তিনি ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেছেন। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আমি আসতে পেরে মনে করছি আমাদের নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার ষাটের দশকের একত্র হই। বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের কোনো জায়গা নেই, যারা মনে করে তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদল (জাসদ)’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, মাহফুজ উল্লাহর সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশক থেকে। আমার ঘণিষ্ট বন্ধু ছিলেন। এই এমুহূর্ত মাহফুজ উল্লাহকে দরকার ছিল তখন তিনি ছেড়ে গেলেন। কোনো হুমকি ভয়ভীতি মাহফুজ উল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। মৃত্যুর সময় আত্মতুষ্টি নিয়ে যেতে পারেননি। মাহফুজ উল্লাহ জনগণের ঐক্য ও আন্দোলনের কথাই বলে গেছেন ।

বিশিষ্ট সাংবাদিক নুরুল কবির বলেন, মাহফুজ উল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। তার যে বৈশিষ্ট ছিল তা তিনি শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন রেখে ছিলেন।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। আমি জেলে যাওয়ার দুইদিন আগে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, তাহলে একটা কনফারেন্স করব, আমি বললাম দরকার নেই। তিনি মুখে হাসি রেখেই অনেক সত্য কথা বলতেন। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় সত্য কথা বলার সুযোগ নেই। মাহফুজ উল্লাহ সাহস করে অনেক কথা বলেছেন। জাতীয়তাবাদী স্বাধীন সত্তা ছিলেন, এক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই কথা বলতে পেরেছেন।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, মাহফুজ উল্লাহ কোনো দলের অনুগত ছিলেন না। তার পছন্দের দল ছিল, মত ছিল। তিনি একটা ভারসাম্য রেখে কথা বলতেন। মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন অন ম্যান আর্মি ।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মাহফুজ উল্লাহ পাবলিক কনফারেন্সে তিনি ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছেন। তিনি হেসে হেসে কথা বলে গেছেন। সত্যকে সত্য বলে গেছেন। বইয়ের মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস লিখে গেছেন।

গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাফর উল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশ একজন স্বীকৃত পেশাজীবীকে হারিয়েছে। তার শেষ বই দুইটা কি ধরণের গবেষণাধর্মী। সেখানে তিনি স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ওসমানীকে নিয়ে বই লিখতে শুরু করেছিলেন ।

নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মাহফুজ উল্লাহ নিজের মতের সঙ্গে অন্যের মতকে সম্মান জানাতেন।

প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, এমন নির্ভিক সত্যকে সত্য বলার সাংবাদিক খুব কম। তিনি মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটতেন। তার মত সাংবাদিক পাওয়া দুষ্কর। তিনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনন্য একজন ভালো মানুষ। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসা জানাতেন। তিনি চিন্তা চেতানায় অনেক অগ্রগামী ছিলেন।

পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদাত হোসেন বলেন, মাহবুব উল্লাহর ছোট ভাই হিসেবে আমাদের কাছে আসতো। ওই সময় থেকে আমাদের ছেড়ে কথা বলতো না। তিনি সাংবাদিকতায় এসেও যুক্তির নিরিখে কথা বলে গেছেন। টকশোতে মাহফুজ উল্লাহ কোনো ভয়ে কথা বলতো না। মাহফুজ উল্লাহর কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে থাকতাম, তার কাছ থেকে আমি শিখেছি। মাহফুজ উল্লাহ অনন্য সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, মাহফুজ উল্লাহকে আমি ছোটভাই হিসেবে জানতাম। তিনি এত দ্রুত চলে যাবেন ভাবতেও পারিনি । তিনি ছিলেন অত্যান্ত সবচ্ছতার অধিকারী, তাকে এই মুহূর্তে খুব দরকার ছিল।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, যে দেশে মুক্তচিন্তা নেই সেখানেও তিনি যুক্তি দিয়ে সত্যকে বলার চেষ্টা করছেন। যে সমাজে কথা বলা ছিলো কঠিন তিনি সেখানেও যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন। এ দেশে তিনি কথা বলার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি ছিলেন। আমরা একই রাজনীতি করেছি। মাহফুজ উল্লাহর টকশোর কথায় আমি ছিলাম মুগ্ধ। তার বইগুলো এত সুন্দর ছিলো যা প্রশংসনীয়।

সিপিডি ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাহফুজ উল্লাহ ভাই ছিলেন একজন গবেষক। তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো নিবিড়। তিনি যুক্তির নিরিখে কথা বলতেন । তার সঙ্গে মতপার্থক্য কখনো হলেও অনেক সম্মান দেখাতেন।

আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নুহ-উল-আলম লেলিন বলেন, আমি আর মাহফুজ উল্লাহ ছিলাম একই ব্যাচের। তিনি ঢাকা কলেজের এবং আমি জগন্নাথ কলেজের। রাজনৈতিকভাবে আমরা ছিলাম দুই মেরুর। তবে আমরা দুজনের ছিলো ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ।

অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, আজকে আমাদের জাতীর জীবনে যেরকম অন্ধকার নেমে এসেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে ওইটা মৃত্যু সমাজ। এক্ষেত্রে মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ব্যতিক্রম। মাহমুজ উল্লাহ ছিলেন সত্য প্রকাশে আপসহীন। আমরা প্রায় একইসঙ্গে টকশোতে বসতাম, এক এলাকায় থাকতাম। ওর আমার ভিতর কোনো বিভেদ ছিলো না। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *