ঢাকা: একজন রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্য অনেক। পাশাপাশি মা হিসেবে নিজের দুই সন্তানের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে তারই অবদান। প্রধানমন্ত্রীর দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নিজ নিজ পেশায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনাম অর্জন করেছেন, পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও। জয় একজন তথ্য প্রযুক্তিবিদ। পড়েছেন ভারতের নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ স্কুল, ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুতুল একজন অটিজম বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানী। পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সজীব ওয়াজেদ জয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটা কথা বলে থাকেন যে, তিনি যেমন রাজনীতি মায়ের কাছে শিখছেন, তেমনি লেখাপড়ার উৎসাহও তিনি মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানিতে ছিলেন শেখ হাসিনা। পরে সেখান থেকে চলে আসেন ভারতে। প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান— ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি মা শেখ হাসিনার হাত ধরেই। জয়-পুতুল দু’জনকেই ছোট বেলায় নিজে পড়াতেন তিনি। বিয়ের পর ছাত্রজীবনের তুখোড় রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছেড়ে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্রত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
কিন্তু ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার এ ব্রত অনেক কঠিন করে ফেলে। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে তিনি সপরিবারে ভারতে পৌঁছে নির্বাসিত জীবন শুরু করেন। দিল্লিতে ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে সংসার পাতেন। শুরু হয় সংগ্রামমুখর জীবন। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে একদিকে স্বামী-সংসার-সন্তানের খেয়াল রাখা, অন্যদিকে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। রান্না-বান্না নিজ হাতেই করতেন। সকাল হতেই ছেলে-মেয়েদের স্কুলের জন্য সাজিয়ে দিতেন তিনি। তখন জয়-পুতুল দুই ভাইবোন দিল্লির একটি স্কুলে পড়তেন। জয় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন— তারা ভাই-বোন হেঁটে স্কুলে যেতেন। তাদের ভাই-বোনের পড়াশুনা নিজেই দেখিয়ে দিতেন তাদের মা শেখ হাসিনা।
এরপরে আসে আরও কঠিন সময়। দলে সৃষ্টি হয় বিভেদ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দল দুই ভাগ হয়ে যায়। শেখ হাসিনা দিল্লি থেকেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। পাশাপাশি লন্ডনেও দলকে পুনর্গঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময়টাতেই তার ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে উঠছিল। এরইমধ্যে সেন্ট জোসেফ স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে জয়কে। এদিকে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছেলেকে হোস্টেলে রেখে মেয়ের হাত ধরে ফিরে আসেন দেশে। একজন মা হিসেবে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে ছেলেকে ভিন দেশের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে রেখে দেশের সেবা করতে দীর্ঘ ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটিতে পা রাখেন তিনি।
দেশে ফিরেই দলকে পুনর্গঠিত করতে সারাদেশ চষে বেড়ান তিনি। মেয়ের পড়াশুনার দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি ভারতে ছেলে কেমন পড়াশুনা করছে, সেই খোঁজখবরও রাখতেন নিয়মিতই। ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে থাকেন মেয়ে পুতুল। ওদিকে ভারতে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হন জয়। পরে সেখান থেকে পড়তে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর রাজনীতি ও লোক প্রশাসনের ওপর মাস্টার্স করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তবে, তার এ শিক্ষাজীবন মোটেও মসৃণ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ মুখেই একাধিক বক্তব্যে বলেছেন— টাকার অভাবে তার ছেলে জয়ের সেমিস্টার মিস হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে জয় চাকরি করে লেখাপড়া চালাতেন। আজ তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানী, তথ্য প্রযুক্তিবিদ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্ট্রা। তার মা শেখ হাসিনা গর্ব করে তো বলেনই, ‘তথ্য প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার চালানোর ক্ষেত্রে ছেলে জয়ই তার শিক্ষক’।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৭ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘ইয়াং গ্লোবাল লিডার’ হিসেবে নির্বাচন করে। জয় ২০১৬ সালে জাতিসংঘের ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর আইসিটি’ লাভ করেন।
এদিকে, তার বোন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম মোকাবিলায় শুধু দেশেই নয় বিশ্বেও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের অটিজম বিষয়ক পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুতুলকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অটিজম স্পিকস’-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে’ অন্তর্ভুক্ত আছেন। পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পুতুল ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’, ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ‘গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদক