সারাদেশে নানা ধরণের অপরাধ বাড়ছে। বিশেষ করে নতুন ধরণের অপরাধ প্রতিদিনিই ঘটছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নৈতিক অধঃপতন যতই এগিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৃনমূল থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায়, কিছু সংখ্যক মানুষ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কয়েক ধরণের পন্থা অবলম্বন করেন। টাকা, নারী বা মদ অকার্যকর হয় এমন কোন মানুষের আনুকূল্য পেতে হলে তেলবাজির আশ্রয় নেয়। পৃথীবিতে খুব কম মানুষ পাওযা যাবে, যারা নিজের সামনে নিজের প্রশংসা শুনতে চায় না। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন বা বড় বড় পদে আসীন থাকেন, তারা নিজের প্রশংসা দেখা বা শুনার মাত্রা থেকে আদর বা ভালবাসার জন্ম দেয়। ফলে অতি উৎসাহী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে অল্প সময়ে বেশী প্রাপ্তীর বোঝা বহন করতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছে আর নিজের বোঝা অন্যদের গাঢ়ে চাপিয়ে দিয়ে নেতার দল ভারী করে নিজেই নিজের নেতার প্রতিপক্ষ নেতা হয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থার কারণে অপরিপক্ক পন্থায় নেতার সংখ্যা বাড়ছে আর নেতৃত্বের ক্ষেত্র তৈরী করতে গিয়ে নতুন নতুন অপরাধ সংঘটন হয়ে যাচ্ছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোন মানুষ যদি সঠিক বিচার না পায় বা অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হয়, তবে সে সংক্ষুব্ধ হয়ে অনেক সময় অন্যয় জেনেও বড় ধরণের অপরাধ করে ফেলে বোকার মত। আর এতে ফেঁসে যায় ইচ্ছামত। আবার বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, কোন অপরাধী অন্যায় করেও যদি রেহাই পায় বা অপরাধ করাকালে উৎসাহ পায় বা সহযোগিতা পায়, তবে সে বেপরোয়া হয়ে যায়, যা নতুন নতুন অপরাধের জন্ম দেয়।
দেখা যায়, পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ এমন ভাবে বাড়ছে যে, এতে রাষ্ট্রকে অপরাধের বোঝা নিতে হচ্ছে। পরিবারের মধ্যে অমিল, সামাজের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা, সংগঠনে দ্বন্ধ, ক্ষমতার দ্বন্ধ ও বিরোধীতার প্রতিযোগিতা থেকেও অপরাধ জন্ম নিচ্ছে। এ সবের মূল কারণ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যতই হ্রাস পাচ্ছে ততই মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। আর এই দূরত্ব থেকে গর্ত, গর্ত থেকে নদী, সাগর থেকে মহাসাগর তৈরী হতে চলছে। এই দূরত্ব যতই বাড়ছে অপরাধও ততই বাড়ছে। দূরত্বের ক্ষেত্র, গর্ত, নদী, সাগর বা মহাসাগর তৈরী হওয়ায় অপরাধের রীতি ও ধরণও নতুন নতুন রুপ নিচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু নতুন নতুন অপরাধের জন্ম হচ্ছে, যার সঙ্গে মানুষ পূর্ব থেকে অপরিচিত।
সময়ের চাকায় হু হু করে অপরাধ বেড়ে যাওয়া ও নতুন নতুন অপরাধ সৃষ্টি হওয়ায় তা দমনে রাষ্ট্রকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র অনেক সময় নতুন নতুন অপরাধ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকে না। যা ঘটে তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে রাষ্ট্রকে দিন দিন নতুনভাবে আপডেট হতে হচ্ছে অপরাধ দমনের জন্য।
এক সময় ছিল, রাজনীতি, শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতাকে মানুষ অন্য রকম সম্মানের চোখে দেখতো। দিন যতই যাচ্ছে, ততই এই সম্মানের জায়গাটা ছোট হয়ে আসছে। ফলে ভালবাসা কমে গিয়ে অপরাধ জন্ম হচ্ছে। এক সময় রাজনৈতিক নেতা, সরকারী বা বিরোধী দলেরই হউক বা সামাজিক নেতাই হউক, তাদের মানুষ মাথানীচু করে সম্মান করতেন। এখন এই সম্মানের জায়গাটা ছোট হয়ে আসছে। কারণ রাজনৈতিক নেতাদের এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মারধর করে, রক্তাক্ত করে, খুন করে, গুম করে। এমনকি বিরোধী দলকে শুন্য করতে জনসভায় বোমা হামলা করে শত শত নেতা-কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রপতিকেই শুধু নয়, স্বপরিবারেও রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে পৃথীবিতে বাংলাদেশকে অপরাধের রেকর্ড ভঙ্গ করতে উৎসাহিত করে।
আবার এমন সময় ছিল, যখন শিক্ষক ও সাংবাদিকরা সরাসরি রাজনীতি করতেন না। এতে করে সরকারের ভুল ধরতে সাংবাদিকদের সহজ হতো ও শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের মানুষ করতে নিজের মত করে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু এখন এই দুটি সমাজ সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত হয়ে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে এক দল মঞ্চে, আরেক দল রাস্তায় অবস্থান করায় বৈষম্য তৈরী হয়েছে। এতে ভালবাসায় ফাঁক তৈরী হওয়ায় বাড়ছে অপরাধ।
যেমন, সরকারী দলের ছাত্র নেতাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে শিক্ষকদের অনেক কাজ করতে হয়। আবার সরকার সমর্থিত সাংবাদিকদের পক্ষে সরকারের সমালোচনা করা সম্ভব হয় না। আর বিরোধী দলের সাংবাদিকদের পক্ষে সরকারের সমালোচনা করা ঝূঁকিপূর্ন হয়। এতে সরকারের সমালোচনা তেমনভাবে না হওয়ায় রাষ্ট্র ও জনগনের সমস্যাগুলোরও সরকার খোঁজ পায় না। এছাড়া সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলোতে দূর্নীতি হয়ে থাকলেও সরকার জানতে পারে না, কারণ সমালোচনা হয় না, তাই। এতে করে দিন দিন জনগন ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়, যাতে নতুন নতুন অপরাধের ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে সহজে।
সুতরাং সামাজিক আন্দোলন তৈরী করে মানুষিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে না পারলে সামনের দিনে নৈতিকতার অধঃপতন এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে, যেখান থেকে আর বের হওয়া যাবে না। যেমনটি সম্ভব হয়না মহাসাগরকে ছোট গর্তে ফিরিয়ে আনতে।
বিশেষ সম্পাদকীয়
গ্রামবাংলানিউজ