ঢাকা: একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী আর নেই। আজ মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটায় তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। খবরটি নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। তিনি বাংলাদেশে সুবীর নন্দীর চিকিৎসার বিষয়টি সমন্বয় করেছেন এবং তাকে সিঙ্গাপুর নেয়ার পর সেখানকার হাসপাতালের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। সুবীর নন্দীর বয়স হয়েছিল ৬৩।
সামন্ত লাল সেন জানান, সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থা গত কয়েকদিন ধরে বেশ সংকটাপন্ন ছিল। শনি ও রোববার তার দুটি হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সোমবার সকালে আরেক দফা হার্ট অ্যাটাক হয়।
সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর তার তিনবার হার্ট অ্যাটাক হয়। ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল এ শিল্পীর। ১৮ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৩০শে এপ্রিল সিঙ্গাপুর নেওয়া হয় সুবীর নন্দীকে। সেদিন বিকেলেই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে বরেণ্য এই শিল্পীর চিকিৎসা শুরু হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের এমআইসিউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখানে তার সঙ্গে ছিলেন মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী। বরেণ্য এই সংগীতশিল্পীকে দ্রুত সিঙ্গাপুরে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রসঙ্গত, ১৪ই এপ্রিল রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে আনার পর সুবীর নন্দীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টেও ছিলেন এ শিল্পী। সুবীর নন্দী সিএমএইচে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. তৌফিক এলাহির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। কয়েক বছর আগে তার হার্টে বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। কিডনির সমস্যাও ছিল। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো তাকে। ১৪ই এপ্রিল ঢাকার সিএমএইচে নেয়ার পর তার মারাত্মক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। সুবীর নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী সেসময় মানবজমিনকে জানিয়েছিলেন, ১২ই এপ্রিল একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মৌলভীবাজার গিয়েছিলেন তারা। অনুষ্ঠান শেষ করে ১৪ই এপ্রিল রাতে বাবা-মাকে নিয়ে ট্রেনে ঢাকায় ফিরছিলেন। রাত ৯টা নাগাদ উত্তরার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে সেখানে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তার পরামর্শেই বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন সুবীর নন্দী। ১৯৫৩ সালের ১৯শে নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় তার জন্ম। বাবার চাকরি সূত্রে শৈশব কেটেছে চা বাগানে। পরিণত বয়সে গানের পাশাপাশি চাকরি করেছেন ব্যাংকে। প্রাইমারিতে পড়ার সময় মা পুতুল রানীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ির পর ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন সুবীর নন্দী। সিলেট বেতারে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬৭ সালে। এরপর ঢাকা রেডিওতে সুযোগ পান ১৯৭০ সালে। রেডিওতে তার প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্লেব্যাকে আসেন সুবীর নন্দী। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অশিক্ষিত’ সিনেমাটি। সেই সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিন আর সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ধীরে ধীরে সুবীর নন্দীর কণ্ঠের গান ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এই শিল্পী। চারবার পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘দিন যায় কথা থাকে’, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বারাত নিয়া’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’সহ অসংখ্য গান। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ বাজারে আসে ১৯৮১ সালে। ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না’, ‘সুরের ভুবনে’, ‘গানের সুরে আমায় পাবে’ ছাড়াও ‘প্রণামাঞ্জলী’ নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবাম রয়েছে এ শিল্পীর।