শিশুসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

ray_chowdhury_bg_35415আজ ২০ ডিসেম্বর। শিশুসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ দিবস।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তারই অমর সৃষ্টি।

উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ মে) ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তার ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তার পৈত্রিক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে।

একুশ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার সখা, সাথী, মুকুল ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে সুরু হয়। প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়।
তখনই আলাপ হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। সে বন্ধুত্ব আমৃত্যু অটুট ছিল।

১৯১৩ সালের এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা ১৩২০ সনের বৈশাখ থেকে প্রকাশিত হতে লাগল শিশুসাহিত্যের কিংবদন্তীতুল্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’। সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রক, লেখক ও চিত্রকর স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

শুধু নিজেই লিখলেন না, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা ঘিরে তৈরি করলেন ছোটদের নতুন ধারার নতুন লেখক-গোষ্ঠী। উপেন্দ্রকিশোরের প্রেরণায় সেকালের অনেক খ্যাতনামা লেখক লেখিকা যেমন কলম ধরলেন ছোটদের জন্য, তেমনি তার পরিবারের লোকজনও। ঠাকুর পরিবারের মতো এই আর এক অবাক-করা গুণী পরিবার! বড়ো ছেলে সুকুমার তো সবার সেরা, তার সঙ্গে আছেন মেয়ে সুখলতা, পুণ্যলথা। ছেলে সুবিনয়, সুবিমল। ছোটভাই কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন। সে এক জমজমাট লেখক পরিবার, যার ধারা বাংলা শিশুসাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়কে আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে।
১৮৮৬ সালে ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়, এবং তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরেরর সংসার জীবন শুরু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল, এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।

যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে তার প্রথম বই “ছেলেদের রামায়ণ” প্রকাশিত হয়। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে অতৃপ্ত উপেন্দ্রকিশোর ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন, এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানের একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফী ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে।
১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো- গুপি গাইন বাঘা বাইন, ছোটদের মহাভারত, সাতমার পালোয়ান, টুনটুনির গল্প, গল্পমালা, ছেলেদের মহাভারত, ছেলেদের রামায়ন, কুঁজো আর ভূত, বাঘ খেকো শিয়ালের ছানা, লাল পরি নীল পরি প্রভৃতি। এ ছাড়া তার রচিত ছোট ছোট অসংখ্য গল্প নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *