ঢাকা:‘মাগো, প্রার্থনা করো। আমি বোধ হয় বাঁচবো না। মরে গেলে ক্ষমা করে দিও।’ কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদছিলেন অপরাজিতা বড়–য়া। মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে এই প্রান্তে কাঁদছিলেন মা।
গতকাল বনানীর কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ের ফারুক রূপায়ন টাওয়ারে (এফআর) আগুন লাগার পরপর ফোনে মা সুজাতার কাছে এভাবেই শেষ বিদায় নিয়েছিলেন অপরাজিতা। বাক্যটি শোনার পর মায়ের প্রাণটা যেন উড়ে গিয়েছিলো। বোনসহ স্বজনদের নিয়ে তিনি দ্রুত ছুটে যান এফআর টাওয়ার এলাকায়। তখন আর অপরাজিতাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না ফোনে।
চিৎকার করে কাঁদছিলেন মা সুজাতা। বারবার বলছিলেন, ‘মাগো, ও মা, তুই ফিরে আয় মা। তুই সুস্থভাবে ফিরে আয়।’
এভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যদিয়ে পার হয় দীর্ঘ সময়। মা সুজাতা তখন পাগলপ্রায়। এরমধ্যেই বিকাল ৫টার পরেÑ ‘ওই যে, ওই যে…’ বলে চিৎকার করেন অপরাজিতার মাসি। তার সঙ্গে চিৎকার করতে করতে এফআর টাওয়ারের নিচে ছুটে যেতে চান অপরাজিতার মা সুজাতা। তাদের বাধা দেয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, র্যাব। কিন্তু বাধা মানতে নারাজ সুজাতা। বারবার বলছিলেন, ‘আমার মা বেঁচে আছে। ওই যে আমার মা… আমাকে যেতে দিন।’ অপরাজিতাকে ১২তলা থেকে নামানো হয়েছে লেডারে (যান্ত্রিক মই) করে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অপরাজিতা জানিয়েছেন এক বিভীষিকাময় সময়ের গল্প। মৃত্যুর হাত থেকে ফেরা অপরাজিতা ফোনে জানান, দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় এফআর টাওয়ারের ১২তলায় অফিসের একটি কক্ষে আটকে ছিলেন। আগুন লেগেছে জানার পরপরই অন্যদের সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করেছেন অপরাজিতাও। ছুটে গিয়েছিলেন সিঁড়ির দিকে। কিন্তু সেদিকে আর এগুতে পারেননি। ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। চোখ জ্বলছিলো। তাকানো যাচ্ছিলো না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। সিঁড়িতে পা দিলে হয়তো ধোঁয়াতেই মারা যেতেন। তাই ফিরে যান। অফিসের একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়ে ফোনে মা’সহ স্বজনদের জানান তার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কথা।
অপরাজিতা বড়–য়া বলেন, ভাবিনি জীবিত ফিরতে পারবো। ¯্রষ্টা সহায় ছিলেন বলেই বাঁচতে পেরেছি। তিনি জানান, ১২তলার ওই কক্ষের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শুরু থেকেই ‘বাঁচান বাঁচান’ চিৎকার করছিলেন। কিন্তু তখনও কেউ তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে যাননি। বলতে বলতে কান্না করছিলেন অপরাজিতা। কথা আটকে যাচ্ছিলো তার। অপরাজিতার মা সুজাতা জানান, জানালা থেকে হাত নেড়ে, চিৎকার করে সহযোগিতা চেয়েছিলো অপরাজিতা। কিন্তু মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছিল। কিছুতেই অপরাজিতার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছিলো না। এরমধ্যেই হঠাৎ অপরাজিতার ফোনে কল যায়। মাসির সঙ্গে কথা হয় তার। তখন অপরাজিতা জানান, পাশেই আগুন জ্বলছে। তবে এখনও তিনিসহ সাত আট জন সহকর্মী একটি রুমে সুস্থ আছেন।
এরমধ্যেই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের নজরে পড়ে এই তরুণীর বাঁচার আকুতি। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে তারাও লেডার নিয়ে ভিড়তে পারছিলেন না ১২তলার ওই জানালার পাশে। পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে তবেই লেডারে করে অপরাজিতাকে উদ্ধার করা হয়।
ডার্ড গ্রুপের এইচআর বিভাগের এক্সিকিউটিভ অফিসার অপরাজিতা বড়–য়া। তাদের অফিসটি ওই ভবনের ১২তলায়। মাত্র আট মাস আগে তিনি চাকরিতে যোগ দেন। চট্টগ্রামের মেয়ে অপরাজিতার পিতা বাবুল বড়–য়া ও মা সুজাতা বড়–য়া। এক ভাই দীপ্ত বড়–য়া, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরিবারের সঙ্গে থাকেন মগবাজারের ওয়্যারলেস গেইট এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়নরত অপরাজিতা। তার আগে লেখাপড়া করেছেন সিটি কলেজে। অপরাজিতাকে ফিরে পেয়ে দীর্ঘসময় বুকে জড়িয়ে কান্না করেন মা সুজাতা। তিনি বলেন, ‘আমার মা মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেছে’।
এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত