নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের নামে-বেনামে ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
তারপরও কোনো ধরনের মামলা করছে না দুদক। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা প্রায় তিন মাস আগে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়ে মামলার সুপারিশ চাইলেও কমিশন অনুমতি দেয়নি।
মামলার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, যেহেতু আলোচিত সাত খুনের আসামি নূর হোসেনকে কোনো ধরনের সম্পদ বিবরণী নোটিশ দেওয়া কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করা যাচ্ছে না। যে কারণে এ মুহূর্তে কমিশন মামলার অনুমতি দেয়নি।
তিনি আরো জানান, জেলে থাকা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সম্পদের নোটিশ দেওয়া যায় না। তাই দুদক নূর হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থায় যাচ্ছে না।
তবে দুদক আইন বলছে ভিন্ন কথা। দুদক আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করলে, পলাতক থাকলে বা কোনোভাবে হদিস না পাওয়া গেলেও নোটিশ দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে তার নিকট আত্মীয়র কাছে কিংবা তা পাওয়া না গেলে তার বাসার সামনে দর্শনীয় স্থানে নোটিশ জারি করা যায়।
নোটিশ জারির পর অভিযুক্ত ব্যক্তি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজে বা আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পদের হিসাব পেশ করতে পারেন। নোটিশের পরও কেউ সম্পদের হিসাব পেশ না করলে তার দখলে থাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা যায়।
কিন্তু অনুসন্ধানে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলেও অদ্যাবধি সম্পদের হিসাব চেয়ে তার কাছে নোটিশ পাঠানো হয়নি। এ ক্ষেত্রে দুদকের একধরনের অনাগ্রহ লক্ষ করা গেছে।
এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদকের অনুসন্ধানে তার মোট ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে পাঁচতলা একটি বাড়ি এবং নূর হোসেনের ও তার সন্তানদের নামে নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রুটে চলাচলকারী এবিএস পরিবহনের লাক্সারি ৩০টি বাস পাওয়া গেছে। এসব গাড়ি নারায়ণগঞ্জ টু চিটাগাং রোডে চলাচল করলেও এখন বন্ধ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে ওই সব সম্পদের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে কলকাতা পুলিশের হাতে আটক নূর হোসেনের আয়কর ফাইল অনুসারে তার মোট আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। যেখানে আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ চাষ। তবে আয়কর ফাইলে কোথাও তার বাড়ি কিংবা বাসের কথাটি উল্লেখ করেননি।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ ওয়ার্ড কমিশনার নূর হোসেনের সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, ১৯৮৬ সালে ট্রাকের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় কয়েক বছরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি, মাছের খামার এবং পরিবহন ব্যবসা। তার ছোবল থেকে বাদ যায়নি মসজিদের সম্পত্তিও।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শিমরাইল মৌজায় ৩৭৩ নম্বর দাগে প্রায় ১১ শতাংশ জমির ওপর সাত কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেন নূর হোসেন। প্রকৃত জমির মালিক নাজির উদ্দিনের ছেলে আশ্রাব উদ্দিনকে ভয় দেখিয়ে মাত্র ২০ লাখ টাকায় হাতিয়ে নেন জমিটি।
মাত্র ১৭ লাখ টাকায় নারায়ণগঞ্জের লাল মিয়ার ছেলে আদম আলীকে ভয় দেখিয়ে শিমরাইল মৌজায় ৭২ ও ৭৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমির ওপর পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছেন ছয়তলা ভবন।
এ ছাড়া রয়েছে শিমরাইল মৌজায় ৩১২ নম্বর দাগে ছয়তলা ভবন, রসুলবাগে সাড়ে আট কাঠা জমির ওপর সাততলা ভবন, সিদ্ধিরগঞ্জ মৌজায় ১০ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে সাততলা নির্মীয়মাণ ভবন। যার অধিকাংশই সরকারের জমি কিংবা অন্যের জমি দখল করে নির্মাণ করেছেন। নূর হোসেন রাজধানীর গুলশান-২-এ দুটি ফ্ল্যাট, বনানী ও ধানমন্ডিতে আরো দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, নূর হোসেন কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমির মালিক বলে অভিযোগ রয়েছে। যার অধিকাংশই দখল করা হয়েছে। শিমরাইলে তার বাড়ির পেছনে রয়েছে ৪০ বিঘার মৎস্য খামার। খামারের মালিকদের বঞ্চিত করে নূর হোসেন ১৫ বছর ধরে চাষ করেছেন। রয়েছে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো মসজিদ ভেঙে মাছের আড়ত স্থাপন করার অভিযোগ।
১৯৮৫ সালের ট্রাক হেলপার নূর হোসেন ১৯৮৭ সালে ট্রাক ড্রাইভার। ১৯৯১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। ২০১২ সালে কাউন্সিলর হন। দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন।