রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম : কওমী মাদ্রাসার কড়া শাসন, শৃঙ্খলিত জীবন, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে ওঠা। এর পর সারাদিনই পড়ালেখা। মাদ্রাসা বন্ধ থাকলেও ছুটি নেই। মাদ্রাসার ৪ দেয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকতে হয়। এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে গত ১৯ মাস ধরে মাদ্রাসা ও পরিবারের কাছে নিজেকে মৃত! করে রেখেছিল হেফাজতকর্মী আল ফারুক।
গত বছরের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতবিরোধী পুলিশের অভিযানের পর নিখোঁজ থাকে ফারুক। পুলিশি অভিযানে ফারুক মারা গেছে ধরে নিয়ে তার গায়েবি জানাজা দেয় ফারুকের পরিবার। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ মাস পর চট্টগ্রামের চকবাজারস্থ হজরত মিছকিন শাহ’র মাজার থেকে মৃত আল ফারুককে জীবিত উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
কওমী মাদ্রাসার বন্দি জীবন
চট্টগ্রামে গোয়েন্দা হেফাজতে আল ফারুক জানান, তিনি হেফাজতে ইসলামকে ভালোবাসেন। কিন্তু কওমী মাদ্রাসার শৃঙ্খলিত জীবন আর কঠোর নিয়ম কানুন তার ভালো লাগে না। ফারুক জানায়, তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলায়। বাবার নাম সোলেমান বিন মোবারক। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ফারুক ৩য়। খুব ছোটবেলাতেই তাকে ঢাকার একটি কওমী কোরআন হেফজ খানায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে শৃঙ্খলিত জীবনে সে পরিপূর্ণ কোরআন শরীফ মুখস্ত করে একজন কোরআনে হাফেজ হিসেবে পরিণত হয়। এর পর ঢাকার বাড্ডার উম্মুল কোরা মাদ্রাসায় ৫ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। এই মাদ্রাসায় আরো বেশি শৃঙ্খলিত জীবন আল ফারুককে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। গোয়েন্দা পুলিশকে ফারুক জানায়, উম্মুল কোরা মাদ্রাসায় প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে জাগতে হয়। কোরআন তেলওয়াত, ফজরের নামাজ এবং ক্লাসের কার্যক্রম চলে জোহর নামাজ পর্যন্ত। জোহর নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে মাগরিবের সময় পর্যন্ত আবার ক্লাস চলে। মাঝখানে আসরের নামাজের জন্য বিরতি দেওয়া হয়। মাগরিবের পর এশার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আবারো ক্লাস করতে হয়। রাত ১০টায় রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। মাদ্রাসায় প্রতিমাসের শেষে বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার তিনদিন ছুটি দেওয়া হয় এবং সরকারি বিভিন্ন দিবসসমূহে মাদ্রাসা বন্ধ থাকলেও মাদ্রাসার ভেতর থেকে কোন ছাত্রকে বের হতে দেওয়া হতো ন।
মাদ্রাসা বন্ধ থাকুক বা খোলা থাকুক চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকতে হতো ফারুকসহ মাদ্রাসার সব ছাত্রকে। এই বন্দিত্ব থেকে পালাতেই গত বছরের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মতিঝিলের সমাবেশে আসার সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল আল ফারুক।
নিজেকে নিখোঁজ রেখে মৃত নাটক
গোয়েন্দা পুলিশকে ফারুক জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে মাদ্রাসার হুজুরদের নির্দেশে অন্যসব ছাত্রদের সঙ্গে ঢাকার শাপলা চত্বরে আসে। শাপলা চত্বরে পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘাত সংঘর্ষ শুরু হলে নিজ মাদ্রাসার অন্যান্য ছাত্র ও তাদের নিয়ন্ত্রণকারী হুজুরদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফারুক। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঢাকা থেকে বিকেলের মধ্যেই চট্টগ্রামগামী বাসে উঠে পরদিন সকালে চট্টগ্রাম চলে আসে ফারুক। এর পর সে চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে অবস্থান নেয়। মসজিদে বেশ কিছুদিন থাকার পর সে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মসজিদ মাজারে থাকতে শুরু করে। মাজারে অবস্থান নেওয়া প্রসঙ্গে ফারুক জানায়, মাজারে খাওয়া দাওয়া থাকতে কোন সমস্যা হয় না। মাজারে বিভিন্ন মানুষ খাবার দাবার নিয়ে আসেন। সেখান থেকে প্রতিবেলার খাবার হয়ে যায়। কোরআনে হাফেজ হওয়ায় সে কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া পড়ে কিছু টাকাও পেতো। দীর্ঘদিন এভাবে লুকিয়ে থাকলেও পরিবারের কাছে ফোন করে জানায়নি যে সে জীবিত আছে। নিজেকে মৃত সাজিয়েই নিখোঁজ থাকে ফারুক।
পরিবারের কাছে মৃত ফারুক
শাপলা অভিযানের পর ফারুক ফিরে না আসায় কুমিল্লার চান্দিনায় ফারুকের পরিবারসহ অন্যসবার কাছে সে ছিল মৃত। ৫ মের শাপলা অভিযানের পর ফারুক মাদ্রাসা কিংবা নিজ বাড়িতে ফিরে না আসায় সবাই ধরে নেয় ফারুক শাপলা অভিযানে মারা গেছে। ফারুককে মৃত ভেবে কুমিল্লায় তার গায়েবানা জানাজা, কুলখানি, চেহলাম এবং সর্বশেষ চলতি বছরের ৫ মে ফারুকের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীও পালন করে ফারুকের বাবা-মা।
যেভাবে ফারুকের সন্ধান পায় পুলিশ
ফারুকের বাবা সোলেমান বিন মোবারক জানান, গত বছরের ৫ মে থেকে ফারুক নিখোঁজ ছিল। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িসহ সর্বত্র ফারুককে আমরা অনেক খুঁজেছি কোথাও তার সন্ধান না পেয়ে মৃত ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু গত ৩১ আগস্ট ফারুক তার মায়ের মোবাইলে হঠাৎ ফোন করে জানায়, ‘আমি ভাল আছি। আমার জন্য দোয়া কর’। সে কোথায় আছে জানতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের লাইন কেটে দেয় এবং মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফারুক। কিন্তু তার অবস্থান সে পরিবারের কাছে জানায় না।
ফারুকের বাবা বলেন, এভাবে ফোন করার কারণে আমাদের মনে হয়েছিলো আমাদের ফারুককে কেউ আটকে রেখেছে, তাকে বাড়ি ফিরতে দিচ্ছে না। এই ধারণার প্রেক্ষিতে গত ৯ নভেম্বর চান্দিনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন সোলেমান বিন মোবারক। এর পর ফারুককে উদ্ধারে আইনি সহায়তা চেয়ে গত ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবরে আবেদন করেন তিনি। পরে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মোবাইল ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে ফারুকের অবস্থান জানতে সক্ষম হয়। সর্বশেষ বুধবার রাতে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই সন্তোষ কুমার চাকমার নেতৃত্বে নগর গোয়েন্দা পুলিশ নগরীর চকবাজার এলাকার চট্টগ্রাম সরকারী মহসিন কলেজ সংলগ্ন মিছকিন শাহ’র মাজার থেকে ১৯ মাস ধরে মৃত থাকা ফারুককে জীবিত উদ্ধার করে।
রাইজিংবিডি