চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দন থেকে উড্ডয়ন করেছিল বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খী। ১৫ মিনিটের মধ্যেই উড়োজাহাজটি মেঘের সীমা পেরিয়ে উঠে যায় ৩০ হাজার ফুট উপরে।
ককপিটে ক্যাপ্টেনের দায়িত্বে সফি। ফার্স্ট অফিসার মুনতাসির ক্যাপ্টেনের বাম পাশে বসা।
যাত্রীরা কেউ মুঠোফোনে গেম খেলছেন, কেউ চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। ক্রুরা যাত্রীদের মাঝে খাবার বিতরণের কাজে ব্যস্ত। সবকিছুই ঠিকঠাক। এ সময় ১/ডি নম্বর সিটে বসা এক ব্যক্তি টয়লেটের উদ্দেশ্যে উঠে গেলে সিটটি খালি হয়। তখনই ইকোনমিক ক্লাসের ১৭/এ নম্বর সিটে বসা যাত্রী পলাশ উঠে গিয়ে বসে বিজনেস ক্লাসের ওই খালি সিটে। সঙ্গে একটি ব্যাকপ্যাক।
বিষয়টা দৃষ্টিকটু মনে হওয়ায় জুনিয়র স্টুয়ার্ড সাকুর সিট বদলানোর কারণ জানতে চাইলেই পলাশ দাঁড়িয়ে সাকুরের গায়ে হাত দিয়ে ইংরেজিতে বলেন, ‘এই বিমানটি ছিনতাই করা হয়েছে! অবিলম্বে ককপিটের দরজা খুলুন। যদি বিমানটি অবতরণ করে তাহলে আমি এটা উড়িয়ে দেব’। এরই মধ্যে ব্যাগপ্যাক থেকে একটি অস্ত্র, একটি লাইটার ও বিস্ফোরকের মতো দেখতে কিছু একটা বের করে হাতে নেন পলাশ।
ওইদিন উড়োজাহাজে থাকা ক্রু ও যাত্রীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পলাশের আচরণ দেখে তাকে মানসিকভাবে সুস্থ মনে হচ্ছিল না। সে হুমকি দিচ্ছিল, গালিগালাজ করছিল। তবে যাত্রীদের কোনো ক্ষতি করেনি। পলাশ বার বার চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমি একজন স্কটিশ নাগরিক। আমার মাত্র একটিই দাবি।
তাহলো, আমি আমার স্ত্রীকে ফিরে পেতে চাই। সে একজন সেলিব্রেটি…। ’ এ সময় একটি ফাঁকা শৌচাগারের দরজার সামনে পটকা জাতীয় কিছু একটা ফোটান পলাশ। বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে কেবিনের ভিতর। তার এক হাতে বিস্ফোরকের ফিউজ ধরা। আরেক হাতে লাইটার।
চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমি জানি বিমানটি যখন অবতরণ করবে তখন আমাকে গ্রেফতার করা হবে। তাহলে বিমানটি আমি উড়িয়ে দেব’। সামনে সশস্ত্র ছিনতাইকারী দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মধ্যে। তখন উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে বাম দিকের দ্বিতীয় সারিতে বসা ছিলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক এমডি কাজী মশিউর রহমান। সাহস করে তিনি পলাশের কাছে জানতে চান, তার স্ত্রী এই ফ্লাইটে আছে কিনা। জবাবে পলাশ জানায় নেই। আরও একটি বিস্ফোরণ ঘটায় পলাশ। ককপিটের দরজায় একের পর এক লাথি মারতে থাকে।
এসময় সাকুর বিশেষ সংকেত পাঠিয়ে ক্যাপ্টেনকে সতর্ক করে দেন। সংকেত পেয়ে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারেন, ভিতরে হাইজ্যাক কিংবা কোনো ঘটনা ঘটেছে। ক্যাপ্টেন ককপিটে থাকা বিশেষ ক্যামেরার মাধ্যমে ভিতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। ওই সময় পলাশ একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল এবং ককপিটে ধাক্কা দিচ্ছিল।
ক্যাপ্টেন সফি কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। তার হাতে ১৫০ যাত্রীর প্রাণ। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারকে অবহিত করেন। ৩০ হাজার ফুট ওপর থেকে অনেকটা খাড়াভাবে দুলতে দুলতে নামতে থাকে উড়োজাহাজটি। ততক্ষণে উড়োজাহাজের সব যাত্রী বিষয়টা জেনে গেছেন। আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। ৩২ মিনিটের মধ্যে ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করে। খুলে দেওয়া হয় জরুরি এক্সিটগুলো। যাত্রীরা নেমে যান।
নিজেই এক্সিট দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন মশিউর রহমান। ক্যাপ্টেন সফি ও ফার্স্ট অফিসার মুনতাসির ককপিটের ওপরে ‘ওভার হেড এক্সিট’ রশি দিয়ে নেমে যান। শুধু সিনিয়র স্টুয়ার্ড সাগর ও সাকুর থেকে যান। সুযোগ বুঝে সাকুরও লাফ দিয়ে নেমে যান। থেকে যান শুধু সাগর। সাগরের জামা খুলে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয় পলাশ।
স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বেরিয়ে আসে সাগর। তার কাছ থেকে ভিতরের অবস্থা জেনে প্রায় ৪০ মিনিট পর বিমানের ক্রুদের পোশাক পরা একজনসহ তিনজন কমান্ডো বিমানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তারা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী পলাশকে নামিয়ে আনেন।