মানব সভ্যতা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, গুরু শিষ্য বহুমাত্রিক মিথস্ক্রিয়া পরম্পরা রসায়নে আমরা আধুনিক সভ্যতা ধারণ করে চলেছি। পরম্পরাক্রম বন্ধনে শ্রদ্ধা, প্রগাঢ়তা এবং মমতা না থাকলে আমরা এখনো সে প্রস্তর যুগের বৈতরণী হয়তোবা পাড়ি দিতে পারতাম না!
গ্রিকদার্শনিক সক্রেটিসের মহান ত্যাগী শিষ্যের নাম প্লেটো। প্লেটো তার শিক্ষক সক্রেটিসেরঅনৈতিক মৃত্যু তার জীবনে প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, মমতা, ত্যাগে রচনা করেন, ‘ডায়ালগ’ এবং ‘রিপাবলিক’ গ্রন্হের মতো অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ। যে গ্রন্থের মাধ্যমে শিষ্য প্লেটো তার শিক্ষাগুরু সক্রেটিসকে বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসেন।
আসলে, এ সৃজণে প্রমান করে, ছাত্র-শিক্ষকের পরস্পরের মিথক্রিয়া বদলে দিতে পারে, সমাজ, রাষ্ট্র, জীবনবোধ ও দর্শন।
আমার আজ লেখার উপজ্জীব্য বিষয়- শিক্ষকের দাঁত ভেঙ্গে দিলো ছাত্র!
আমি শিক্ষা বিভাগের, কিংবা রাষ্ট্রের কোনো নীতি নির্ধারক নই। রাষ্ট্রের একজন যৎসামান্য সেবক, আমার এসব বিষয়ে চিন্তা করা একপ্রকার বাতুলতা বৈকি!
আসলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক পরম শ্রদ্ধা, মমতামাখা এক অদৃশ্য আত্মদর্শনের নীল সূতোর টানে গাঁথা।
মায়ের কোল পেরিয়ে, নিষ্পাপ শিশু প্রবেশ করে জীবন জাগরণের উদ্ভাষিত পবিত্র শিক্ষার আলোক ধারায়।শিক্ষকের প্রথম দিনের পরম মমতা, অনুরাগে হাতের পবিত্র আঙ্গুল স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে ছাত্র/ছাত্রীর শিক্ষণ শুরু হয়।
স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ধারাপাত, ইংরেজী বর্ণমালা, বাল্যশিক্ষায় থিতু হলে আস্তে আস্তে শিক্ষাগুরু নিজের কষ্টার্জিত বিদ্যা বিলিয়ে দিয়ে ধন্য হন! গর্ব করেন। সন্তানসম ছাত্রের মনোযোগ বাড়াতে বিদ্যাচর্চায় অনেক সময় দেরি হলে বাসায় খালিবাজারে ফেরেন।
এক সময়ে শিক্ষাগুরুর চশমার লেন্সের দৃষ্টি পুরুত্ব বেড়ে চলে। শরীরটা আগের মতো সায় দেয় না, মাঝবয়সী সময় হয়ে পড়ে বড়োই অপাংক্তেয়?
যে ছাত্রদের নিয়ে একদিন স্বপ্নের পসরা সাজাতেন!একজন প্লেটো, এরিস্টটল, বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন দেখতেন, সে ছাত্র-ছাত্রীরা পরিবার, অভিভাবক, পরিবেশ, সমাজ, কুসংসর্গের আস্করা/অতিরিক্ত আদর/প্রভাবের কারনে এখন ছন্নছাড়া। অলিক অসাড় ভার্চুয়াল/আকাশ সংস্কতির কুপ্রভাবে বয়ঃসন্ধিকাল আর শিষ্যদের পেরোনো হয় না…
মাতা-পিতাসম শিক্ষকেরা হাজারো চেষ্টা করে ও পাঠ আদায়ে ব্যর্থ! হাজারো ছুতো! এলিবাই? ছাত্রটি পড়াশোনার বদলে হয়ে পড়ে রোমিও। অভিভাবকের নিকট হতে পগারপার রপ্ত করা, দামি মোবাইল টাকা পয়সা নিয়ে উচ্ছন্নপ্রথায় শরীরে উল্কি করে, দামি সিগারেট ধরে। হাতে চুড়ি, ভয়ংকর মার্কা কেয়ার কাট, অন্য ছাত্রদের লোভ-ভয় দেখিয়ে বাগে এনে দল ভারি করে। পড়াশোনা না করে, ভালো ছাত্রদের পরীক্ষা হলে খারাপ শব্দদুষণে তটস্থ রেখে দেখে লেখা অভ্যাসে পরিণিত করে।
একটা সময় ভালো শিক্ষকরা রোমিও মার্কা কথিত ছাত্রদের চরম শত্রু হয়ে পড়লো! নীতিবান শিক্ষকবৃন্দ অবাধ্য ছাত্রদের শাসন করার জন্য চেষ্টা করলো? গুনধর অবাধ্য ছাত্ররা সাড়ম্বরে চিৎকার করে বললো, ‘আপনাদের কোনো অধিকার নেই মারার!আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হবে। আমরা থানা পুলিশ করবো।’
ছাত্রদের বাজখাঁই চিৎকারে শিক্ষক মশাই চুপসে গেলেন? শিক্ষক মশাই জীবনের কোনো হিসাবই মেলাতে পারেন না। শুধু ভাবেন নির্বাক মৌনতায় এরি মধ্যে আদরের ছাত্রটি ‘গুরুমারা’ বিদ্যা অর্জন করে নিলেন। কারণ অছাত্র বড়ভাইদের দেয়া বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠনের ফরম ফিলাপে স্নেহরস পানে বুকে সাহস, হাতে বল নিয়ে হয়েছেন দুর্নমিত, অধরা!
বইয়ের ব্যাগে আস্তে আস্তে দখল করে নিল, ছোরা, চাকু, ন্যাসাগু, ক্রিকেট ষ্ট্যাম্প, নাইলন দড়ি, সিগারেট, দিয়াশলাই আরও—কতো কি?
ইভটিজারে স্নেহময় বোকা ছাত্রটি দক্ষ হলো, শিক্ষক নস্যি! দলবেঁধে বয়ঃসন্ধি আকাশ সংস্কৃতিতে উপভোগ। স্কুলের ছাত্রীদের প্রতি লোপুশ ঈগল দৃষ্টি? শিক্ষক মশাই প্রমাদ গুনলেন…
এতো অধ:পতন! তাঁর ছাত্রের? না শিক্ষক সাহেব একটু প্রতিবাদ করলেন। উনি গুণধর ছাত্রকে ছাত্রীদের ইভটিজিং না করার ধমক দিলেন। ইঁচড়ে পাকা ছাত্রের ইগোতে লাগলো! ব্যস রোমিও হবার সুযোগ পেয়ে, গুনধর ছাত্রটি বুকে প্রচন্ড সাহস, হাতে বল নিয়ে এক ঘুষিতে একেবারে খাঁটি ‘গুরু মারা শিষ্য’ হয়ে গেলো!
শিক্ষা গুরু তার মুখে হাত দিয়ে দেখে, তার সামনের দুটি দাঁত শিষ্য (ছাত্র) প্রতিদান হিসেবে নিয়েছে।
কি ভয়ংকর দৃশ্য! একেবারে নায়ক শাহরুখ খান ষ্টাইলে খলনায়ক অমরেশ পুরীর সিনেমার মারামারি দৃশ্যকে ও হার মানিয়েছে?
শিক্ষক মশাই, তার স্নেহের গুণধর ছাত্রকে কি বলে আশীষ দিয়েছেন? আমার জানা না থাকলে ও হয়তোবা, একজন অমরেশপুরী হবার আশীষ দিয়েছেন নিশ্চয়ই!
আসলে দিনে দিনে এক ক্ষয়িষ্ণু বৈশ্বিক নির্লজ্জ সমাজ ব্যবস্থাপনায় আমরা অন্ধকারে মানবসত্তাকে বিকিয়ে দিচ্ছি? কখনো শিক্ষক, কখনো ছাত্র হারাতে চলেছেন, তাদের জৌলুশ মহাকাব্যিক Teacher ও student সম্পর্কের ধারা।
আবহমানকাল হতে আসা আমাদের এ ধারাকে সচল রাখতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের তপস্যা অধ্যয়ন, এর বাইরে কিছু হতে পারে না। তাদের মনের অবগুন্ঠনে যতোক্ষন লোভ, ভোগের ঘুমন্ত দৈত্য জাগবে না, তারা অবশ্যই student থাকবে।
শিক্ষকতা মহান পেশা। আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, আমার প্রিয় শিক্ষকদের। ভোগবাদী চিন্তন, চরম স্বার্থান্ধ শিক্ষণ, বীক্ষণ, বানিজ্যিক ভাবধারা আমার শিক্ষকদের মধ্যে পাইনি, দেখিনি।
আমার শিক্ষকরা অনেক দুর পথ সাইকেলে চেপে ভোরবেলা ভাত তরকারী নিয়ে যথাসময় স্কুলে আসতেন, কোনো ছাত্র ভাত না খেলে বিরতি সময়ে খাইয়ে দিতেন। নিজে আধাপেটা খেয়ে হাসতেন। Teacher শব্দের একরত্তি ও এদিক সেদিক করেননি। আবার শাসনে ও ছাড় দেননি।অভিভাবক স্কুলে এসে বার বার বলতেন-‘সন্তানের শাসনের ভার শিক্ষকের’।
আজ আমাদের দরকার-‘শিক্ষকের মর্যাদায়’ বাদশাহ আলমগীর ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রধান শিক্ষক বরাবর লেখা চিঠি অভিভাবকের।
কমিউনিটি সংস্কারক ও সফলতার নেপথ্যের বুনিয়াদ আত্মদর্শনের বহুমাত্রিক ধারায়, জনবান্ধব পুলিশিং ব্যক্তিত্ব গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম (বার) তার মননশক্তি জাগরণ করে, আগামীর মানবীয় সাম্যবোধ ভাবধারায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত গড়ে তুলেছেন সুদৃঢ়তায়।স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সমাজকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন, মানবীয় শিক্ষন বলয়। যে বলয় হবে, মাদক, বাল্যবিবাহ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাট্টা বলয়। যে বলয়ে নিশ্চিত হবে, শ্রদ্ধা, মমতায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, আক্ষরিক অর্থেই হবে নিরাপদ শিক্ষণ।
পথচলায় একবিংশ ও ভবিষ্যত দ্বাবিংশ শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন দৃঢ় ছাত্র-শিক্ষক বন্ধন। যে বন্ধনে তৈরি হবে, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল, ইবনেসিনা, নিউটন, ডারউইন।
আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর প্রত্যেকের এক বা একের অধিক জীবনের গল্প আছে। যে গল্প সংগ্রাম, বেদনা, যন্ত্রনার… যে গল্পগুলো প্রকাশ হয় না কখনো? একটুখানি দয়া সে যন্ত্রনার ক্ষতে ঢেলে দিতে পারে আনন্দের প্রলেপ। এতে হয়তো আমরা রাতারাতি জগত বদলাতে পারবো না? কিন্তু সেই মানুষটির জগত আমুল বদলে যাবে।
ছাত্র -শিক্ষকের দায়িত্ব, কর্তব্যের সেতুবন্ধন পরম্পরায় আত্মিক বন্ধনে আমরা আবার ফিরিয়ে আনবো আমাদের গর্বের সোনালী বন্ধন। যে বন্ধনে রচিত হবে, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের পথচলায় দিকদর্শন।
লেখক: রাজীব কুমার দাশ, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।