ঢাকা: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহী জওয়ানেরা নৃশংসভাবে হত্যা করেন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে গোটা জাতি।
পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরের নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার। হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া খুনের মামলায় ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের রায় ঘোষণা হয়। তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়নি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও শামীম সিকদার রোববার বলেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর তাঁরা আপিল করবেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল বলেন, ‘হাইকোর্টে আপিল তো শেষ হয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আবেদন করলে তা আপিল হিসেবে বিবেচিত হবে। আমি যতটুকু জানি, আসামিপক্ষ এখনো রায়ের কপি হাতে পায়নি। আসামিপক্ষ রায়ের কপি পেলে তারা আপিল বিভাগে আপিল করবে।’
বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টেও মামলার বিচারকাজ নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন বিচারের সর্বোচ্চ ধাপ আপিল বিভাগেই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের হলে আপিল বিভাগেই মামলার চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাইকোর্ট ১৩৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন। যাবজ্জীবন বহাল আছে ১৮৫ জনের এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রয়েছে ২০০ জনের।
*একনজরে হাইকোর্টের রায়
রায়: ২৭ নভেম্বর ২০১৭
দণ্ড: ফাঁসি বহাল ১৩৯ জনের, যাবজ্জীবন ১৮৫ জনের, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস ৪৫ জন।
*একনজরে বিচারিক আদালতের রায়
ঘটনা: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি
নিহত: ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন
রায়: ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর দণ্ড: ১৫২ জনের ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ১৬১ জনের। ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা ২৫৬ জনের। খালাস ২৭৮ জন। সর্বমোট সাজা ৫৬৮ জনের।
এর আগে নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে, ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিনে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
যা ঘটেছিল
দরবার হল থেকে বিদ্রোহ শুরু: মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল নয়টায় সদর দপ্তরের দরবার হলে। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।
দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তাঁরা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তাঁরা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।
বিডিআরে বিদ্রোহের ঘটনায় দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। ইতিমধ্যে হত্যা মামলায় হাইকোর্টে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে রায় ঘোষিত হয়েছে। তবে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। আদালত সূত্র বলছে, এ মামলার ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৭৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও শামীম সিকদার গতকাল অভিযোগ করে বলেন, এ মামলার বিচারে বিলম্বিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মোশাররফ হোসেন গতকাল জানান, বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৭৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
এই হত্যাযজ্ঞের বিচার প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিশ্ব ইতিহাসে এত লোকের বিচার হয়নি। এটা যেমন অস্বাভাবিক ঘটনা, বিচারে একটু সময় নেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।’