ঢাকা: আইসিস ব্রাইড নামে খ্যাতি পাওয়া বৃটিশ শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৃটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক চলছে। তবে যে যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, শামীমার ভবিষ্যত নির্ভর করছে বৃটেনের স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশন (এসআইএসি) আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। আদালত কি তাকে দ্বৈত নাগরিক হিসেবে রায় দেবে? এমনটি ঘটলে তিনি বাংলাদেশে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়ে বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের সিদ্ধান্ত আইনসম্মত। কেননা, তার এই সিদ্ধান্তের ফলে শামীমা বৃটিশ নাগরিকত্ব হারালেও রাষ্ট্রহীন হবেন না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কি হবে?
ঢাকার পরিষ্কার মনোভাব, আমরা তাকে (শামীমাকে) চাই না। এ সপ্তাহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শামীমাকে ভুলভাবে তার জন্মস্থান যুক্তরাজ্য ও তাকে বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার এতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ মনে করে, শামীমা বেগম বাংলাদেশী নাগরিক নন। জন্মসূত্রে তিনি বৃটিশ নাগরিক। কখনোই তিনি বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের আবেদন করেন নি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম আরো স্পষ্টভাবে বলেন, ‘তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার প্রশ্নই আসে না’।
এর কারণ সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের নিজেরই জিহাদী সমস্যা রয়েছে। বৃটেনের মতো বাংলাদেশও একাধিক হামলার শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে ইসলামী উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীরা ঢাকার একটি রেস্ট্যুরেন্টে ২০ জনকে হত্যা করে। নতুন কোন ব্যক্তিকে, বিশেষ করে কখনো বাংলাদেশে বসবাস করেনি এমন ব্যক্তিদের প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে বাংলাদেশের সরকার সঠিক অবস্থানে রয়েছে।
কিন্তু পরিস্থিতি এতটা সহজ না। কেননা বাংলাদেশী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিবৃতি শুধু দেশীয় আইনের সঙ্গে সঙ্গতিহীনই না, একই সঙ্গে বৃটিশ সরকারকে দেয়া একটি লিখিত কূটনৈতিক পত্রের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। গত বছর বাংলাদেশ বৃটেনকে গোপনে ওই লিখিত পত্র দিয়েছিল।
আইনগতভাবে, শামীমার মতো অবস্থানে থাকা কোন ব্যক্তি বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পাবেন কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশের আদালত এখনো কোন রায় দেয়নি। কিন্তু বৃটেনের স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিল কমিশন (এসআইএসি) সম্প্রতি তিন বাংলাদেশী বৃটিশ নাগরিকের বিষয়ে দুইটি রায় দিয়েছেন। যাদের মধ্যে অন্তত দুই জনের অবস্থা শামীমা বেগমের আইনি অবস্থার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ও গত বছরের নভেম্বরে রায় দুইটি দেয়া হয়। উভয় মামলার রায়ে এসআইএসি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে। বাংলাদেশের সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-১৯৫১ এর ৫ম ও ১৪তম ধারা অনুসারে, বৃটেনে জন্ম নেয়া বাংলাদেশী নাগরিকত্বধারী পিতা-মাতার সন্তান বাংলাদেশের নাগরিক হবে। ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তার এই নাগরিকত্ব থাকবে। বর্তমানে শামীমা বেগমের বয়স ১৯ বছর। এখন তার ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার যে অবস্থান নিয়েছে, তা এ দুই ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, ১৯ বছর বয়সী শামীমাকে বের করে দেয়ার জন্য বৃটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসআইএসি আদালতে তা অবশ্যই বৈধ প্রমাণিত হবে।
তবে আইন যা-ই বলুক না কেন, বর্তমানে শামীমার বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নেই। বাংলাদেশের সরকার তাকে সেভাবেই বিবেচনা করবে। শামীমার একমাত্র আশা যে, বৃটিশ আদালত এ বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি যদি আদালতকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেয়া সিদ্ধান্ত বৃটেনের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে তার বৃটিশ নাগরিকত্ব নাও কেড়ে নেয়া হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে শামীমার আইনজীবী আরেকটি জটিলতার মুখে পড়েছেন। গত বছর বৃটেনকে বাংলাদেশ সরকার একটি কূটনৈতিক পত্র পাঠায়। যাতে শামীমার ইস্যুতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে বিপরীতধর্মী বার্তা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কেন এই বার্তা পাঠিয়েছে, এসআইএসি আদালতের দেয়া দুই রায়ে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মামলা দায়েরকারী ওই দুই ব্যক্তির বয়স ছিল ২১ বছরের বেশি। এই বয়সে তাদের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বহাল রাখার একমাত্র উপায় ছিল, ২০০৮ সালে জারি করা একটি প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের প্রয়োগ। ওই অর্ডারে বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তিদের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বহাল রাখার নির্দেশ জারি করা হয়। দুই বাংলাদেশীর নাগরিকত্ব নির্ধারণী রায় দিতে গিয়ে এসআইএসি আদালতকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, ওই প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার কি শুধু ‘ন্যাচারালাইজড’ বৃটিশ নাগরিকদের (যেসব বাংলাদেশী নাগরিক বৃটেনে গিয়ে সেদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন) ওপর প্রয়োগ হবে? নাকি জন্মসূত্রে বৃটিশরাও এর আওতাভুক্ত হবেন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বৃটিশ এসআইএসি আদালত যে বাংলাদেশীর মামলার রায় দিয়েছে, তার নাম দেয়া হয়েছে জি-৩। তখন এসআইএসি আদালত রুল জারি করে যে, ২০০৮ সালে জারি করা প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার জি-৩ এর জন্য কার্যকর হবে না। ফলস্বরূপ ২১ বছর বয়সে জি-৩ তার বাংলাদেশি পরিচয় হারায়। এমন অবস্থায় জি-৩ এর বৃটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হলে সে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। ফলে মামলায় বৃটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরাজিত হয়। এ পরাজয়ের পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশন এক কূটনৈতিক পত্রে বাংলাদেশ সরকারকে ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার স্পষ্ট করার আহবান জানায়। কূটনৈতিক পত্র সাধারনত গোপনীয় থাকে। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে ই-৩ নামধারী আরেক বাংলাদেশী বৃটিশ অধিবাসীর নাগরিকত্ব নির্ধারণী রায়ে ওই কূটনৈতিক পত্রের রেফারেন্স দেয়া হয়। যাতে বাংলাদেশের ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ২০০৮ এর প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার জন্মসূত্রে বৃটিশ নাগরিকদের ওপর কার্যকর হবে। এবং বয়স ২১ হলেও এটা প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের এই অবস্থান তার পূর্বের বক্তব্যের বিপরীত। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার মেনে নিয়েছে যে, বৃটেনে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশি পিতা-মাতার সন্তান বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। একইসঙ্গে ২১ বছর বয়সের পরেও তাদের এই নাগরিকত্ব বহাল থাকবে।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করলেও এসআইএসি আদালত ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের আইনি ব্যাখ্যার প্রতি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। ফলে ই-৩ এর মামলায় আবারো বৃটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরাজিত হয়।
যা হোক, এই মামলায় যুক্ত আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক পত্রটিই এখন মামলার প্রধান আকর্ষণ। এসআইএসি আদালতে শামীমার নাগরিকত্ব নিয়ে শুনানিতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর আরো চাপ প্রয়োগের আহবান জানানো হবে। বাংলাদেশ এখন শামীমা বেগমকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এই দাবি টেকসই হবে না। যদি সেই কূটনৈতিক পত্রই শামীমার নাগরিকত্ব নির্ধারক হয়, আদালত যদি বৃটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থানকে গ্রহণ করে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে পূর্বের জি-৩ ও ই-৩ এর মামলার বিষয়েও ভাবতে হবে। এমন পরিস্থিতে একটি কূটনৈতিক সংঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছে। সবশেষে আবারো বলতে হয়, শামীমা বেগমের বিষয়ে কোনো সহজ উত্তর নেই।
(অনলাইন দ্য স্পেকটেটর অবলম্বনে)