যে ডাক্তার জেলায় যাবে না তার দরকার নেই

Slider সারাদেশ


ঢাকা:সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেসরকারি হাসপাতালে এসে যেন রোগী দেখতে না হয় সেজন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ‘বিশেষ ধরনের সেবা’ চালুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব চিকিৎসক জেলা হাসপাতালে রোগী দেখতে চাইবেন না, তাদের ওএসডি করে নতুন নিয়োগ দিতে বলেছেন তিনি। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর নির্দেশনা আসে। নার্সরা যদি সেবা দিতে না চান, তাহলে তাদেরও চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের পড়াশোনা হচ্ছে, সে বিষয়ে তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, আমাদের ডাক্তাররা সবসময় প্রাইভেট চিকিৎসা দিতেই পছন্দ করেন। পৃথিবীর বহু দেশ আছে, সরকারি চাকরি যতদিন করে, ততদিন প্রাইভেট চাকরি করতে পারে না। এমনকি সিঙ্গাপুরেও যাবেন, ডাক্তাররা প্রাইভেট চিকিৎসা করতে গেলে ওই হাসপাতালের মধ্যেই আলাদা ব্যবস্থা আছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা চালু থাকার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটা কিন্তু আমরা অন্যান্য জেলা হাসপাতালেও করে দিতে পারি, যেন তাদের বাইরে না যেতে হয়।
সন্ধ্যার পরে বা ছুটির সময় ওখানেই একটা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা বা আলাদা একটা উইং করে দেয়া যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে রোগী দেখার পরে প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে কেউ রাত ১২টা, ১টা, ২টা পর্যন্তও নাকি অপারেশন করেন। যে ডাক্তার রাতভর অপারেশন করবে, সে আবার সকাল ৮টার সময় এসে রোগী দেখবে কী করে? তার মেজাজ তো এমনিই খিটখিটে থাকবে। এটা যেন না হয় সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া দরকার। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ- সুবিধা বাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসকদের সুবিধার জন্য উপজেলা পর্যায়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হবে। তিনি বলেন, কোন্‌ জেলার কোন্‌ উপজেলার জন্য হাসপাতাল লাগবে, তা কত শয্যার হতে হবে, চিকিৎসক এবং নার্স এবং অন্যান্য কি সুবিধাদি প্রয়োজন তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি জরিপ করে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবা সমপ্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে, এর আগে জরিপ করে দেখতে হবে হাসপাতালগুলোতে কত রোগী যাচ্ছেন? কতজন অ্যাটেনডেন্ট রয়েছেন? ডাক্তাররা সেখানে থাকছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের সেখানে বদলি করা হচ্ছে তাদের কর্মস্থলে যেতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, দেশে কতগুলো মেডিকেল কলেজ আছে সেটারও একটা সার্ভে করা উচিত, সেগুলোর কি অবস্থা তা জানার জন্য।

তিনি বলেন, কতজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক রয়েছে, শিক্ষার কি কি সুযোগ রয়েছে, সেটা আগে দেখা দরকার। বড় জেলা, যেগুলোর ১০ থেকে ১২/১৩টি উপজেলা রয়েছে সেখানে আমরা মেডিকেল কলেজ করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার অনেক হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে আড়াইশ’ বেডের করে দিলেও দেখা যায় যে, সেখানে রোগী যাচ্ছে না, বা রোগী পাওয়া যাচ্ছে না, আবার অনেক হাসপাতালে সার্জন বা অ্যানেসথেসিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন থেকে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সেখানকার জনগণের প্রয়োজন সাপেক্ষে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে এবং প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং সেখানকার সকল মেডিকেল কলেজ এর অধিভুক্ত হবে।
চিকিৎসার জন্য রেফারেল সিস্টেম চালুসহ দেশে প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকটি হাসপাতালেই অনলাইন রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে। নার্সদের ভালোভাবে দায়িত্ব পালন না করার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের তো রোগীদের সেবা দিতে হবে। সেজন্যই আমরা তাদের পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছি। আমার পরিষ্কার কথা, আমি তাদের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দিচ্ছি। কারণ, রোগী যেন সেবা পায়। তিনি বলেন, একজন নার্সের কাজ কিন্তু শুধু ওষুধ খাওয়ানো নয় বরং পাশ্চাত্যে নার্সরাই রোগীর সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে রোগী সম্পর্কে সার্বিক রিপোর্ট তৈরি করে ডাক্তারকে দেখায়। ডাক্তার সেই রিপোর্ট দেখে, চিকিৎসা দেয় এবং রোগীর সার্বিক সেবা করাটাই নার্সদের দায়িত্ব। তিনি বলেন, নার্সদের আমি সম্মান দিয়েছি ঠিক। কিন্তু বোগীর সেবাটা করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। না করলে তারা কাজে থাকবে না, চলে যাবে। আমরা নতুন লোক প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসবো।

তিনি এসময় চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ দু’বছর করে দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এক বছর তারা থাকবে যে প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানে এবং আর একটি বছর তাদের যুক্ত থাকতে হবে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তার সরকার এটি চালুর উদ্যোগ নেয়ার পরে বিষয়টি এখন কি অবস্থায় রয়েছে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী।
দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা কিন্তু পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হবে না। হাসপাতাল হবে উপজেলা হাসপাতাল। আর এখানে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। এরপর হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট রোগীকে রেফার করা হবে। তিনি মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলেন, আমাদের গ্রামগঞ্জে এটা চালু আছে, দাই বলে যাদেরকে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া। যাতে কেউ চাইলে ঘরে বসে যাতে ডেলিভারির (সন্তান প্রসব) কাজটা করতে পারে।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার এবং নার্স এবং বিশেষ করে ডাক্তার না থাকার অনবরত অভিযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য প্রত্যেকটি হাসপাতালে অনুপস্থিতির বিষয়টি তদারকির জন্য বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থাটাও চালু করতে হবে। তিনি এ সময় রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডিজিটাল হেলথ কার্ড চালুর প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি চিকিৎসক এবং নার্সদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা ইনস্টল থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং রোগীর কিছু হলেই চিকিৎসকের ওপর চড়াও হওয়ার মতো মানসিকতা জনগণকে পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার এবং নার্সদের উদ্দেশ্যে বলেন, যখনই একটা রোগী আসে সঙ্গে সঙ্গেই তারা যেন চিকিৎসার ব্যবস্থাটা নেয়, ফেলে না রাখে। সেবামূলক মানসিকতাটা যেন চিকিৎসকদের মাঝে গড়ে ওঠে সেজন্য সচেতনতাটা সৃষ্টি করা দরকার। তিনি এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি ভালোভাবে প্রচারেও জোর দেয়ার পাশাপাশি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন কারিকুলাম যুগোপযোগী করার এবং দেশে- বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরো গতিশীল করার পরামর্শ প্রদান করেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল অটোমেশন পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, তাহলে এক্ষেত্রে একটা জাবাবদিহিতা থাকবে এবং অপচয় রোধ হবে এবং যেটা প্রয়োজন শুধু সেটাই ক্রয় করা হবে, যেটা না হলেও চলে সেটা আর ক্রয় করা হবে না। তিনি এ সময় সঠিক মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।

সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরে আজকাল কিডনি, হার্ট এবং ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি এগুলো কেন হচ্ছে তা দেখার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। দেশে ডিজিটাইজেশনের প্রভাবে জনগণের ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতনতা কমে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি যারা দিনের নির্দিষ্ট সময় কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা যেন কাজের পর যথাযথ বিশ্রাম নেন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখেন সেজন্য প্রচারণা চালাতেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, রোগ সারানোর দিকে দৃষ্টি দেয়ার চাইতে রোগ যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালিক, প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসানসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *