ঢাকা: রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার আগে মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন ওরফে রেজাউল করিম ওরফে আবু মুহাজির (৩০) ৩৯ লাখ টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এই হামলার জন্য ভারত থেকে তিনি অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেন। হোলি আর্টিজান মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি মামুনুর রশিদ এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল শনিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে তাঁকে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় একটি বাস থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় মামুনুর রশিদকে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান গ্রেপ্তার মামুনুরের স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানান, গ্রেপ্তারের সময় মামুনুরের কাছ থেকে একটি ডায়েরি, চারটি খসড়া মানচিত্র এবং নগদ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৫ টাকা পাওয়া গেছে। মামুনুরের বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রামের শেখের মারিয়া গ্রামে। বাংলা মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদ্রাসায় তিনি পড়েছেন। সবশেষ ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদ্রাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরায়ে হাদিসে পড়াশোনা শেষ করেন। পরে বগুড়ার সাইবার টেক নামে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অফিস অ্যাপ্লিকেশন কোর্স করে ওই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি নেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সাইবার টেকে চাকরি করা অবস্থায় নজরুল নামের একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে মামুনুর রশিদ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর সাংগঠনিক নাম দেওয়া হয় রিপন। এর আগে তিনি রশিদ নামে পরিচিত ছিলেন। ডা. নজরুল ওই সময়ে জেএমবির একাংশের আমির ছিলেন। মামুনুরের প্রাথমিক কাজ ছিল চাঁদা সংগ্রহ করে ডা. নজরুলের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ আরও জানান, সারওয়ার জাহান (পরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত) জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে অর্থ সংগ্রহ ও দাওয়াতি কাজ শুরু করেন। মামুনুর বিকাশের দোকান লুটের ছয় লাখ টাকা, সিগারেট বিক্রেতার টাকা ছিনতাই করে এক লাখ টাকা, গাইবান্ধার এক ঘটনায় আরও এক লাখসহ মোট আট লাখ টাকা জোগাড় করে সারওয়ার জাহানের হাতে তুলে দেন। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তামিম চৌধুরী (পরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত) ও সারওয়ার জাহানের মধ্যে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে সমঝোতা হয়। ওই বৈঠকে মামুনুর উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তাঁকে সুরা সদস্য মনোনীত করা হয়। সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মামুনুনের নেতৃত্বে একটি দল ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য ভারতে যান। হোলি আর্টিজানে হামলার আগে মামুনুর ৩৯ লাখ টাকা জোগাড় করে সারওয়ার জাহানের হাতে তুলে দেন।
র্যাব জানিয়েছে, মামুনুর হোলি আর্টিজান মামলার পরিকল্পনা ও অর্থ সরবরাহের কাজে যুক্ত ছিলেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। র্যাবের দাবি, উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি জঙ্গি মামলা তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। ওই সব হামলার নেতৃত্বে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী।
হোলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী। এ মামলার আসামি হিসেবে তিনি গ্রেপ্তার আছেন এখন।
হোলি আর্টিজানে হামলা মামলার বিচারকাজ চলছে। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর এই মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, তাঁরা হলেন রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন।
মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন গতকাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন এই মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামি পলাতক রয়েছেন। তাঁর নাম শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ।
হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে ৫ জন ঘটনাস্থলে নিহত হন। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে ৮ জন নিহত হন।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালায়। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ৬ জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১ জন রেস্তোরাঁকর্মী।