৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য দূরে ঠেলে দিয়েছে। সংবিধান এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে তারা ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে। গতকাল বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলে এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। সভায় অন্য বক্তারা বলেন, এখন আমাদের জনগণকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদের পরিচালনায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, আব্দুল মান্নান, ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন প্রমুখ। সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আহমেদ আযম খান, আতাউর রহমান ঢালী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিলকিস জাহান শিরিন, এমরান সালেহ প্রিন্স, খন্দকার মাশুকুর রহমান, কাজী আবুল বাশার, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, আবদুল খালেক, আনোয়ার হোসাইনসহ বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে দেশের এই যে উন্নয়ন তার ভিত কিন্তু শহীদ জিয়ার হাতে গড়া। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণেই দেশে দুর্ভি হয়েছিল। মানুষ অনাহারে দিন কাটিয়েছে। বাসন্তী তার ইজ্জত ঢাকতে পারেনি। আজকেও ১০ বছর ধরে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। সমাজতন্ত্রের নামে তারা সে সময় কী লুট করেছিল তা জানি। গার্মেন্ট, কৃষি, শিল্প সব কিছুই জিয়াউর রহমানের হাতে সূচনা।
তিনি বলেন, পরাজয় মনে করলেই পরাজয়। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের ভাইদের মুক্ত করতে হবে। গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। আজকে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, আমাদের নেত্রী, গণতন্ত্রের মাতাকে কারাগার থেকে বের করে আনতে হবে। সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমগ্র দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশনেত্রীকে মুক্ত করে আনতে হবে।
নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, হতাশার কোনো জায়গা নেই। এগিয়ে যেতে হবে। তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। শহীদ জিয়া আমাদের সেই শিা দিয়েছেন। যারা হতাশ, তারা কখনো জিয়াউর রহমানের অনুসারী হতে পারে না। আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জিয়াউর রহমানের জীবনীকে তিনটি ভাগে ভাগ করে বলেন, সৈনিক, রাষ্ট্রপতি ও রাজনৈতিক জীবনে শহীদ জিয়াউর রহমান সফল। বিশ্বের আর কোথাও কোনো নেতার জীবনে এ ধরনের সাফল্যের সমাহার ঘটেছে বলে আমি জানি না। শহীদ জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। দেশের সীমানা রার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর তাকে বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়। তিনি সৌভাগ্যের অধিকারী। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার পর যখন দেশবাসী দিশেহারা তখন ৭ নভেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতিকে নতুনভাবে দিকনির্দেশনা দেন। তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। মৃত্যুর পর তার নামাজে জানাজায় যে পরিমাণ লোক হয়েছিল তা দেশের ইতিহাসে বিরল। তিনি দেশের মানুষকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। খাল কাটা কর্মসূচি শুরুর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন। তিনি সব েেত্র সফল। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন। যেখানে তারা ব্যর্থ সেখানেই শহীদ জিয়াউর রহমান সফল। এ জন্য তারা তাকে আজো ভয় পায়। ৩০ ডিসেম্বর তার সর্বশেষ প্রমাণ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বর নয়, ২৯ ডিসেম্বরই নির্বাচন হয়েছে। ১০ বছর মতায় থেকে আওয়ামী লীগ এত ‘উন্নয়ন’ করেও ভোট ডাকাতি করেছে। কারণ তারা বিএনপিকে ভয় পায়। দেশের ৮০ ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগের বিদায় ও বিএনপিকে মতায় দেখতে চেয়েছিল, যা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তারা জেনেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা এবার সাহস নিয়ে নির্যাতন সহ্য করে মাঠে ছিল।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, শহীদ জিয়াউর রহমান আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। যে সরকারই মতায় আসুক শহীদ জিয়া তার অবস্থানেই থাকবেন। ১৯৭১-এ ২৫ মার্চের পর দেশে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল সে সময় কঠিন সাহস নিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এ নিয়ে ’৯৬ সালের আগে কেউ প্রশ্নও তোলেনি। শহীদ জিয়া নাকি দেশে প্রথম মার্শাল ল’ জারি করেছিলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তিনিই বাংলাদেশের মানুষকে একটি আদর্শ দিয়েছেন। সেটি হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই আদর্শের ভিত্তিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত। আজো আছে এবং আগামীতেও থাকবে। বিএনপি থেকে দূরে সরে গেলে চলবে না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে বিএনপি দেশের রাজনীতিতে ভ‚মিকা রাখবে এবং জনগণের সমর্থন নিয়ে আবার মতায় আসবে ইনশাআল্লাহ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বর দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। সম্পূর্ণ নীলনকশার নির্বাচন হয়েছে। কোনোভাবেই সংবিধানসম্মত নির্বাচন হয়নি। জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। বিদেশী গণমাধ্যমের দিকে তাকালে দেখবেন সবাই একই কথা বলছে। এই নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে সংবাদ লিখছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আমি হতাশ, হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখে। দু’টি কারণে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তার একটি ছিল- নির্বাচনে গেলে হয়তো একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হবে এবং বিএনপির হাজার হাজার লাখ লাখ নেতাকর্মী উজ্জীবিত হবে। যার ফলে দলের ভেতরে গতি সঞ্চারিত হবে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমরা সবাই জানি যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু সেই জায়গা থেকে অন্তত পে সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা সরকার করবে এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ দিকে আমরা সংলাপে যাওয়ার পর আশ্বাস দেয়া হলো যে আর গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার করা হবে না। অথচ নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এভাবে নির্বাচন করা যায় কি করে?
তিনি আরো বলেন, আসলে শহীদ জিয়ার ফিরিয়ে দেয়া জনগণের ভোটাধিকার আমরা আবারো হারালাম। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তাদেরকে মিথ্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আমিসহ অন্যান্য নেতাকর্মী ও প্রার্থীর গাড়িতেও তারা হামলা চালিয়েছে।
আগামীতে দলের করণীয় প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ বলেন, এখন দলকে পুনর্গঠন ও নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করতে হবে। তিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের অভয় দিতে হবে। তাদের মাঝে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের যাদের বয়স হয়েছে তারা সরে যাবো। কিন্তু এই দলটিকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। দুই-তিন মাসের মধ্যে আবারো দল পুনর্গঠন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. মঈন খান বলেন, শহীদ জিয়ার অবদান বহুমাত্রিক। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ থেকে চাল বিদেশে রফতানি শুরু করেন। তার অবদান বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তিনি শহীদ হওয়ার পর তার সততার কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনে তার ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ ছাপানো হয়েছিল।