এবারের মন্ত্রিসভায় যারা থাকছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের৷ আর মন্ত্রিসভায় কারা আছেন তার চেয়ে আলোচনায় কারা নেই৷ আছে তরুণ ও নবীনদের প্রাধান্য৷ আনুষ্ঠানিকভাবে এরই মধ্যে নতুন মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে৷ সোমবার তারা শপথ নেবেন৷
রোববার বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও ৩ উপমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এবং নতুন মন্ত্রীরা শপথ নেবেন৷” এরইমধ্যে তাদের চিঠি দিয়ে এবং টেলিফোনে শপথ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ আর সোমবার শপথের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন৷
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে তালিকা দেয়া হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয় :
১. আওয়ামী লীগের বাইরে ১৪ দলীয় জোট বা মহাজোট থেকে কাউকে মন্ত্রী করা হচ্ছে না
২. বিতর্কিত এবং হেভিওয়েটরা বাদ পড়ছেন
৩. অনেক নতুন মুখ এবং তরুণরা মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত হচ্ছেন
থাকছে না জোট-মহাজোট
বিদায়ী মন্ত্রিসভায় ১৪ দলীয় জোটের মধ্য থেকে জাসদের হাসনুল হক ইনু তথ্যমন্ত্রী, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং জেপি’র (মঞ্জু) আনোয়ার হেসেন মঞ্জু পানিসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন৷ তাদের কেউই নতুন মন্ত্রিসভার তালিকায় নেই৷ অন্যদিকে, মহাজোটের শরীক এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে বিদায়ী মন্ত্রিসভায় তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থাকলেও এবার তারা পুরোপুরি বিরোধী দলে বসছে৷ ফলে নতুন মন্ত্রিসভায় তাদেরও কোনো মন্ত্রী নেই৷ আর এরশাদ ছিলেন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত৷ এবার তিনি হচ্ছেন বিরোধী দলীয় নেতা৷
নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ছেন অনেক হেভিওয়েট এবং সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা৷ তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত হলেন নৌপরিবহণ মন্ত্রী ও পরিবহণ শ্রমিক নেতা শাজাহান খান৷ আরো যারা বাদ পড়ছেন তাদের মধ্যে আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রমূখ৷ বিদায়ী মন্ত্রিসভার ২৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে ২৩ জন বাদ পড়ছেন৷ আর ১৭ জন প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে বাদ পড়ছেন ৯ জন৷
বাদ পড়াদের মধ্যে সমালোচিত যেমন আছেন তেমনি ভালো ইমেজেরও অনেকে আছে৷ যেমন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা বলেছেন অনেক আগেই৷ একারণে তিনি সংসদ নির্বাচনেও দাঁড়াননি৷
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ
আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ ৩২ জন৷ তাদের মধ্যে ২৮ জনই এই প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হচ্ছেন৷ চারজন ২০০৮ সালের মন্ত্রিসভায় ছিলেন৷ এবারই যারা প্রথম মন্ত্রী হচ্ছেন তারা হলেন: মোঃ তাজুল ইসলাম, এ কে আব্দুল মোমেন, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাধন চন্দ্র মজুমদার, টিপু মুন্সি, শ. ম. রেজাউল করিম, মোঃ শাহাব উদ্দিন এবং নুরুল ইসলাম সুজন৷ প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন ইমরান আহমদ, জাহিদ আহসান রাসেল, আশরাফ আলী খান খসরু, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাকির হোসেন, ফরহাদ হোসেন, স্বপন ভট্টাচার্য, জাহিদ ফারুক, মুরাদ হাসান, শরীফ আহমেদ, কে এম খালিদ, ডা. এনামুর রহমান, মাহবুব আলী এবং শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ৷
উপ-মন্ত্রী হিসেবে বেগম হাবিবুন নাহার, এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং মহিবুল হাসান চৌধুরী একদম নতুন হিসেবে মন্ত্রীত্ব পাচ্ছেন৷
নতুনরা যা বলেন
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীদের দপ্তরও বলে দেয়া হয়েছে৷ সোমবার গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার কথা শ. ম. রেজাউল করিমের৷ শুধু মন্ত্রী নয়, তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন এবারই প্রথম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর আস্থা রেখে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি পালন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করব৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সামনে রেখে আমি কাজ করব৷”
এবার মন্ত্রিসভায় তরুণ এবং নতুনদের প্রাধান্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘তরুণ এবং নতুনরাই বড় শক্তি৷ তাদের কাজের আগ্রহ এবং স্পৃহা অনেক বেশি থাকে৷ প্রধানমন্ত্রী এই শক্তিতে আস্থা রেখেছেন৷ আমরাও তরুণ এবং নবীনের শক্তিতে দেশকে আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো বলে আশা করছি৷”
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম এনামুল এনামুল হক শামীমও এবারই প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন৷ আর তিনি পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি ছাত্র রাজনীতির পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছি৷ এবার সংসদ সদস্য হয়েছি এবং প্রধানমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রী করছেন৷ আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ৷ আমরা নতুন এবং তরুণরা এবারের মন্ত্রিসভায় প্রাধান্য বিস্তার করছি৷ আমরা কেমন করবো সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে৷ তবে প্রধানমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকব৷”
বিশ্লেষকরা যা মনে করছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার বলেন, ‘‘১৯৭৩ সালের পর এবারই প্রথম শুধু আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন হচ্ছে৷ তাহলে জোট মহাজাটের বিষয়টি আপাতত আর থাকছে না৷ যদিও আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোটকে সঙ্গে নিয়ে৷ এখন দেখার বিষয় হল ভারসাম্যটা কিভাবে রাখা হয়৷ কারণ জোট-মহাজোট থেকে এখন পর্যন্ত মন্ত্রীদের তালিকায় কেউ নেই৷”
তিনি বলেন, ‘‘মন্ত্রিসভায় নতুন এবং তরুণদের আনা হচ্ছে৷ আমার মনে হয় এতে অভিজ্ঞতার কোনো সংকট হবেনা৷ ২০০৮ সালের মন্ত্রিসভায়ও অনেক হেভিওয়েট বা সিনিয়র নেতারা ছিলেন না৷ তাতে কোনো সমস্যা হয়নি৷ ২০১৪ সালে অবশ্য সিনিয়র নেতাদের মন্ত্রিসভায় আনা হয়৷ আসল কথা হল সিস্টেম৷ যদি সিস্টেম ভালো হয় তাহলে কাজও ভালো হয়৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘সমালোচিত কেউ কেউ বাদ পড়েছেন৷ আলোচিতরাও বাদ পড়েছেন৷ এরমধ্য দিয়ে হয়তো শেখ হাসিনা একটা ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে সমালোচিত হওয়া যাবেনা৷ সমালোচনা হয় এমন কাজ করা যাবেনা৷ আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার কথা তিনি নির্বাচনের পরই বলেছেন৷ কিন্তু সেটা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে৷”
নতুন মন্ত্রিসভায় নারী থাকছেন চারজন৷ আর সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্য থেকেও মন্ত্রিত্ব দেয়া হচ্ছে৷ জানা গেছে, শেখ হাসিনা এবার ক্লিন ইমেজের একটি মন্ত্রিসভা করতে চান৷ এড়াতে চান বিতর্ক৷ আর সামনের দিনগুলোতে যাতে এই মন্ত্রিসভার ক্লিন ইমেজ বজায় থাকে তারও ব্যবস্থা নিচ্ছেন৷ তিনি মন্ত্রিসভায় নতুন এবং তরুণ মুখ এনে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে চান৷ অন্তত, এক বছর জোট-মহাজোট ছাড়াই মন্ত্রিসভা পরিচালনা করে দেখতে চান৷