ঢাকা:ভূমিধস বিজয় পেয়ে চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতা নিশ্চিত করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ভোট জালিয়াতি ও প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হওয়ার কারণে নির্বাচনকে হাস্যকর বলে আখ্যায়িত করেছে বিরোধীরা। নির্বাচন কমিশন সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে বিজয়ী হয়েছে শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর মিত্ররা। মাত্র ৬টি আসনে বিজয়ী হয়েছে প্রধান বিরোধী দল।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়েছে সরকার। দলটি নির্বাচন কমিশনের প্রতি এ নির্বাচনের ফল বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আমরা একটি নতুন নির্বাচন দাবি করছি।
ভয়াবহ সহিংসতা ও তিক্ত বিরোধ এবারের নির্বাচনী প্রচারণাকে ব্যাহত করেছে।
নির্বাচনের দিনেও তা অব্যাহত ছিল, যদিও কর্তৃপক্ষ সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬ লাখ সদস্যকে মোতায়েন করেছিল সারাদেশে। পুলিশ বলেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৩ জন। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে তিন জন। বিরোধী সশস্ত্র কর্মীদের হাতে পুলিশের একজন সহায়ক সদস্য নিহত হয়েছেন বলে সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
এক দশক ক্ষমতায় থাকার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে অর্থনীতি উন্নত করা ও মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কারণে প্রশংসিত ৭১ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছেন, তার প্রধান প্রতিপক্ষ ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোর মাধ্যমে বিরোধীদের ওপর দমনপীড়নের জন্য তার সমালোচনা করছেন সমালোচকরা। বিরোধীরা রোববার অভিযোগ করেছে, শেখ হাসিনার দল ব্যালট দিয়ে বাক্স ভর্তি করেছে এবং নির্বাচনের ফল তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য অসদুপায় অবলম্বন করেছে।
বিএনপির মুখপাত্র সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ৩০০ আসনের মধ্যে ২২১টিতে অনিয়ম হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি ভোটারদের। বিশেষ করে নারী ভোটারদেরকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
‘আমরাই আপনার ভোট দিয়ে দেবো’
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র এসএম আসাদুজ্জামান বলেছেন, তারা অল্প কিছু অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছেন এবং তা তদন্ত করা হচ্ছে। এসব অভিযোগের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেন নি শেখ হাসিনা। তবে ভোটগ্রহণকালে তিনি বলেছেন, ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
রাজধানী ঢাকায় ভোট হয়েছে অনেক শান্তিপূর্ণ। এদিন নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখা গেছে রাজপথে। তবে রাজধানীর বাইরের ভোটাররা ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ করেছেন। আতিয়ার রহমান নামের একজন ভোটার বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে তাকে প্রহার করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। তিনি বলেন, তাদেরকে বিরক্ত না করতে বলে আমাকে। তারা আরো বলে, আপনার পক্ষ হয়ে আমরা ভোট দিয়ে দেবো।
বিরোধীরা বলছে, ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সারাদেশে প্রিজাইডিং অফিসাররা ধীর গতিতে ভোট নিয়েছেন।
৮ই নভেম্বর নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। তারপর থেকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১। পুলিশ বলেছে, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা একটি ভোটকেন্দ্রের বুথে জোর করে প্রবেশ করলে আত্মরক্ষার্থে তাদের দিকে গুলি চালায় তারা। এতে একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ব্যালট বাক্স চুরি করার চেষ্টা করলে পুলিশ আরো একজনকে গুলি করেছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরোধীদের যেভাবে ‘বধ’ করা হয়েছে তাতে শেখ হাসিনার এই বিজয় কলঙ্কিত হয়ে থাকবে। বিরোধীরা দাবি করেছে, নির্বাচনী প্রচারণাকালে তাদের ১৫ হাজারেরও নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার শক্তিকে ভেঙে দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলীয় ১৭ জন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে। তবে তারা বলছেন, এসব অভিযোগ বানানো। আদালত থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে আরো ১৭ জনকে। বিরোধীরা বলে, যেখান থেকে এ রায় দেয়া হয়েছে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বলছে, সরকারের দমনপীড়ন এক ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এতে বিরোধী দলের সমর্থকরা ভোট দান থেকে বিরত থাকতে পারেন। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে গত তিন দশক ধরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে। এ দু’নেত্রী এক সময় একজোট হয়েছিলেন। পরে তারা শত্রুতে পরিণত হন। ৩০ শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার এবং মোট চার বার নির্বাচিত হলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। ২০১৪ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না এমন অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে তাকে বড় বিজয় উপহার দেয় বিএনপি। তারপর থেকেই মিডিয়া বিরোধী কুখ্যাত ও কঠোরতর একটি আইনের মধ্য দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার গলাটিপে ধরার জন্য তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। তারা বলেছে, ভিন্ন মতাবলম্বীদের জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে।
নিজেকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক হিসেবে যে অভিযোগ আছে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলেন, তার আশঙ্কা ছিল তরুণ ভোটাররা সমর্থন দেবে বিএনপিকে। এ বছর ঢাকার রাজপথে ছাত্র আন্দোলনে কঠোর হওয়ার কারণে তার সরকারের কড়া সমালোচনা রয়েছে।