জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারাও বলতে পারছেন না নৌকার বিপক্ষে যেসব আসনে লাঙ্গলের প্রার্থীরা শক্তভাবে নেমেছেন, সেখানে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে সিঙ্গাপুরে ১৪ দিনের চিকিৎসা শেষে আজ সোমবার রাত ৯টায় দেশে ফেরার কথা ছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। কিন্তু রোববার মধ্যরাতে তার উপ-প্রেসসচিব খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিবৃতিতে জানান, মেডিকেল চেকআপ শেষ না হওয়ায় এরশাদ আজ ফিরছেন না। রোববার সন্ধ্যায় দেওয়া আগের এক বিবৃতিতে এরশাদের আজ ফেরার কথা জানানো হয়েছিল। এরশাদ কবে ফিরবেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উন্মুক্ত আসনের বিষয়ে দেশে ফিরে এরশাদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফয়সাল চিশতি।
মহাজোটের কাছে প্রথমে ৭৬ আসন চেয়েছিলেন এরশাদ। পরে কমপক্ষে ৪২টি আসনের দাবি জানান। কিন্তু মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় ২৬ আসন। এসব আসনে নৌকার প্রার্থী নেই। তবে এই ২৬ আসনের অন্তত সাতটিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের 'শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী'। এ কারণে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে মহাজোটের প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ আসনে নৌকা না থাকলেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তিনি ভোট থেকে সরে গেছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির নেতারা।
প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন না পেয়ে 'বিদ্রোহ' করে জাতীয় পার্টি। ১৭৪টি আসনে প্রার্থী দেয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেছিলেন, বিএনপির জোট কোনো কারণে ভোট থেকে সরে গেলেও নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, সে কারণেই শরিক দলের প্রার্থীরা রয়ে গেছেন নৌকার বিপক্ষে। এতে কোনো সমস্যা হবে না।
তবে জাতীয় পার্টি সূত্রের খবর, গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর কাছে অনুরোধ আসে নৌকার বিপক্ষে থাকা লাঙ্গলের প্রার্থীদের নিষ্ফ্ক্রিয় করার। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গাঁ অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জানিয়ে দেন, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এরশাদ দেশে ফিরলে তাকে জানাবেন বিষয়টি। এরশাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা যেসব আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছেন, সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু যেসব আসনে নৌকার বিপক্ষে লাঙ্গলের প্রার্থী রয়েছেন, সেখানে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে।
জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, উন্মুক্ত আসনে অন্তত ৫টিতে তারা জিততে পারেন। বাকিগুলোর অন্তত ৭০টিতে ৫ থেকে ৫০ হাজার ভোট পাবে লাঙ্গল। এ ভোটের কারণে এসব আসন হারাতে পারে নৌকা। আবার ভিন্নমত আছে জাতীয় পার্টির। ভিন্নমতের কয়েক নেতা সমকালকে বলেছেন, জাতীয় পার্টির হাজার হাজার সমর্থক সাধারণত আওয়ামী লীগ বিরোধী। লাঙল ভোটে না থাকলে তাদের ভোট ধানের শীষে চলে যেতো। লাঙল থাকায় আওয়ামী লীগেরই লাভ হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
এরশাদ নিজেই রয়েছেন নৌকার বিপক্ষে লড়াইয়ে। তিনি রংপুর-৩ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পেলেও ঢাকা-১৭ আসনে তার বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী চিত্রনায়ক ফারুক। এরশাদের নির্বাচন সমন্বয়ক ফয়সাল চিশতী গতকালও বলেছেন ঢাকা-১৭ আসনে তারা ভোটে আছেন, থাকবেন।
তবে রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ-৭ আসনে ভোটের লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন নৌকার সমর্থনে। জাতীয় পার্টির অন্তত ২০ প্রার্থী নৌকার সমর্থনে সরে দাঁড়িয়েছেন। নিষ্ফ্ক্রিয় রয়েছেন অন্তত ৫০ জন। বাকিরা ভোটে সরব রয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মহাজোটের প্রার্থী আওয়ামী লীগের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। গত শুক্রবার তার নির্বাচনী সমাবেশে হামলায় অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। নির্বাচন থেকে কোনো অবস্থাতেই সরে দাঁড়াবেন না বলে সমকালকে জানিয়েছেন। মানিকগঞ্জ-৩ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী জহিরুল ইসলাম রুবেলও আক্রান্ত হয়েছেন। তারও অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচন থেকে সরবেন না। শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবেন, ফল যাই হোক।
কুড়িগ্রাম-১ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পাননি গত চারটি নির্বাচনে জয়ী জাতীয় পার্টির এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। নৌকার বিপক্ষে ভোটে রয়েছেন তিনি। তিনিও জানিয়েছেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না। ভোট সুষ্ঠু হলে তার জয় নিশ্চিত। কুড়িগ্রাম-৩ আসনে মাস চারেক আগে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন জাতীয় পার্টির ডা. আক্কাস আলী। তিনি মহাজোটের মনোনয়ন না পেয়ে নৌকার বিপক্ষে লাঙ্গল প্রতীকে ভোটে রয়েছেন।
ঢাকা-৫ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন না পেলেও লাঙ্গল প্রতীকে নৌকার হাবিবুর রহমান মোল্লার বিপক্ষে ভোটে রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ। তিনি সমকালকে বলেছেন, কারও ভোট কাটতে নয়, জয়ী হতে নির্বাচন করছেন। প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তাতেও নির্বাচন থেকে সরবেন না।
খুলনা-১ আসনে নৌকার বিপক্ষে নির্বাচনে আছেন জাতীয় পার্টির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়। তিনি বলেছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী কে কে তা ভাবার আর সময় নেই। তিনি নিজের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। পরিস্থিতি যাই হোক নির্বাচন থেকে সরবেন না।
নির্বাচনী পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, সারাদেশে না হলেও বৃহত্তর রংপুরে জাতীয় পার্টির নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে। বৃহত্তর রংপুরের ২১টি আসনের ২০টিতে ভোট আগামী ৩০ ডিসেম্বর। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ওই আসনে ভোট স্থগিত রয়েছে। এরশাদের দুর্গ-খ্যাত রংপুরের এই ২০ আসনে সাতটিতে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এর বাইরে ১০টি আসনে নৌকার বিপক্ষে লাঙ্গলের প্রার্থী রয়েছেন।
রংপুরে ১৯৯১ সালে ১৮, ১৯৯৬ সালে ২১ এবং ২০০১ সালে ১৪ আসনে জয়ী হয় জাপা। রংপুর-২ আসনে আসাদুজ্জামান চৌধুরী সাবলু, রংপুর-৪ আসনে মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল, রংপুর-৫ আসনে ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর নৌকার বিপক্ষে লাঙলের প্রার্থী। সাবলু ও জাহাঙ্গীর সমকালকে বলেছেন, ফল যাই ভোট থেকে সরবেন না। তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হলে তাদের কিছু করার নেই।
