সিরাজগঞ্জ-৪ উল্লাপাড়া আসনে নির্বাচনের মাঠে সরব আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকাছাড়া বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। এ কারণে দল দু’টির মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতাকর্মীদের নির্বাচনের মাঠে নামাই কঠিন। তারপরও জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে এ আসনে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে সাধারণ ভোটারদের ধারণা। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত আলাদা নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবেÑ এমনটাই মনে করছে সচেতন মহল।
এ আসনের বড় দুই দলেই কোন্দল আছে। কিন্তু জামায়াতে কোন্দল নেই। দলটি সুসংগঠিত এবং বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে এখানে।
উল্লাপাড়া আসনটি উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনের মোট ভোটার তিন লাখ ৮২ হাজার ৪৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯৪ হাজার ৬৩৪ এবং মহিলা ভোটার এক লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫ জন। চলনবিল অধ্যুষিত এবং শস্যভাণ্ডারসমৃদ্ধ এ আসনের রাজনৈতিক নেতারা এখন নির্বাচনের ডামাডোলে ব্যস্ত। হাট-বাজারে চায়ের কাপে রাজনৈতিক ঝড় বইছে। কোন দলের কে মনোনয়ন পাচ্ছেন তা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির এম আকবার আলী এমপি নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতের অ্যাডভোকেট আবু বক্কার সিদ্দিক। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এম আকবর আলীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট শামসুল আলম এমপি নির্বাচিত হন। তারপর একই বছরের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ওয়াই কামালকে হারিয়ে এমপি হন আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ মির্জা। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল লতিফ মির্জাকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী এম আকবর আলী।
এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গাজী শফিকুল ইসলাম শফি এমপি নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতের মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন আওয়ামী লীগের তানভীর ইমাম।
এ আসনে আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে। বর্তমান এমপি তানভীর ইমাম ও সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শফি দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডে শফিকে বরাবরই দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন তানভীর ইমাম। দীর্ঘ দিনের ত্যাগী নেতা শফির অভিযোগÑ তাকে বাদ দিয়ে দলের কমিটি গঠন করা হয়েছে। শফি গ্রুপের নেতাকর্মীরা তানভীরকে মেনে নিতে চাইছেন না। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে জানান স্থানীয়রা।
বর্তমান এমপি তানভির ইমাম দলের বড় অংশকে সাথে নিয়ে কাজ করছেন। অপর দিকে সাবেক এমপি মো: শফিকুল ইসলাম শফি দলের আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন। উপজেলার বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বর্তমান এমপির সাথে রয়েছেন। নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তিনি। তবে ২০১৪ সালের পর উল্লাপাড়ার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে বলে আওয়ামী লীগেরই একটি পক্ষের অভিযোগ। এ ছাড়া বর্তমান এমপির লোকেরা বৈধ-অবৈধভাবে একচেটিয়া বালু ও জলমহাল ইজারা নিয়ে পকেট ভারী করতে ব্যস্ত রয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান এমপি তানভীর ইমামের বাবা এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা। এ কারণে আগামী নির্বাচনে তিনিই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন এমনটাই মনে করেন সাধারণ মানুষ।
অপর দিকে সাবেক এমপি মো: শফিকুল ইসলাম শফি দলের আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন। বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে মাঠে সরব রয়েছেন তিনি। অন্যদিকে বর্তমান এমপির পক্ষের লোকজনের অভিযোগÑ সাবেক এমপি শফির আমলেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। বালু মহাল, জলমহাল দখলে নেয়া এবং তদবির বাণিজ্যসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে শফি বলেন, ‘আমি যাতে নমিনেশন না পাই সে জন্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার সময়ে কোনো নিয়োগ বাণিজ্য বা দুর্নীতি হয়নি। আর এখন কী হচ্ছে তা সাধারণ মানুষ জানে।’
এ আসনে বিএনপিতেও গ্রুপিং আছে। দলের একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন সাবেক এমপি এম আকবর আলী, অপর অংশের নেতৃত্বে আছেন কাজী কামাল। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে একাধিক প্রার্থী কেন্দ্রে লবিং করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন সাবেক এমপি এম আকবর আলী। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে উল্লাপাড়াকে শিক্ষা নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে উল্লাপাড়া বিএনপির তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীরা আকবর আলীর সাথে নেই বলে দাবি করেন কাজী কামাল ও আজাদের নেতৃত্বাধীন কমিটির বেশির ভাগ নেতা। কিন্তু এম আকবর আলী বলেন, অবৈধভাবে গঠিত আহ্বায়ক কমিটির কিছু লোক বাদে উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা আমার সাথে রয়েছে।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী কামাল। জেলা বিএনপির নেতারা কাজী কামালকে আহ্বায়ক এবং আজাদুর রহমান আজাদকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে হামলা-মামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে এই কমিটি। কাজী কামালের দাদা ছিলেন ভূস্বামী। তাদের পরিবার হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহু জমি দান করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উপকারভোগী মানুষজন কাজী কামালের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল। সে জন্য তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছেন এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনে শহীদ নাজির উদ্দিন জেহাদের বড় ভাই সাবেক ছাত্রদল নেতা কে এম শরফুদ্দিন মঞ্জু। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বড় ভাই কে এম হাসিন শহীদ হন। তিনি এলাকায় সৎ নির্ভীক ও সদালাপী হিসেবে পরিচিত। উপজেলা বিএনপির উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা তাকে পছন্দ করেন। তিনি বিগত আন্দোলন সংগ্রামে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন বলে জানান তৃণমূল কর্মীরা। সম্প্রতি তিনি হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন। হামলা-মামলায় আহত ও কারারুদ্ধ নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেন, নানাভাবে তাদের সহায়তা করেন।
এ আসনের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য উল্লাপাড়া উপজেলা বিএনপির সদস্য আবদুল ওয়াহাব। তিনি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আগামী বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। প্রায় এক যুগ ধরে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ জনসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশে থেকে বিগত আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
এ আসনে বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রবীণ সাংবাদিক খন্দকার গোলাম আজাদ। উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই সন্তান উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য গোলাম আজাদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য নজরুল ইসলাম খানের শ্যালক। তিনি বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকার দিয়ে বর্তমানে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে জমা দেয়া বিএনপির উল্লাপাড়া উপজেলা কমিটির সভাপতি তিনি। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী।
কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খানও এ আসনের বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং উল্লাপাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। কেন্দ্রীয় বিএনপির রাজনীতিতে তিনি বেশ সক্রিয়। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচি পালন করার সময় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের হামলায় প্রাণনাশের সম্মুখীন হয়েছিলেন এই নারী আইনজীবী।
অপর দিকে জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান উল্লাপাড়ার বাসিন্দা হওয়ায় তিনি এ আসনের ২০ দলীয় জোটের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি এই জোটের অন্যতম নেতা। এ কারণে তিনি জোটের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, জোটের মনোনয়ন না পেলে রফিকুল ইসলাম খান এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। জামায়াতের বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে এ আসনে। রফিকুল ইসলাম খান এ আসনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে পোস্টার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। উল্লাপাড়ার সর্বত্র তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অসংখ্য মামলা রয়েছে। যার কারণে তিনি প্রকাশ্যে বা জনসমক্ষে আসতে না পারলেও এলাকার মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে জামায়াতের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রায় ৯৮ হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের ভোটের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম খানের জনপ্রিয়তা দেখে ক্ষমতাসীনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। যার কারণে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের পক্ষে যে দিন মনোনয়নপত্র উত্তোলন করা হয়েছে সে রাতেই জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা শাহীনুল আলমকে গ্রেফতার করা করা হয়। এরপর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে উল্লাপাড়া জামায়াতের নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা।