ঢাকা: শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে চাপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোট। দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি জোট শরিকদের দাবি পূরণে দুই জোটেই চলছে নানা হিসাবনিকাশ। নতুন রাজনৈতিক মেরূকরণ হওয়ায় জোটের ছোট শরিকরা বড় আবদার করছেন আসন নিয়ে। জোট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য শরিকদের জন্য অন্তত ৭০টি আসন ছাড়তে হতে পারে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের জন্যও ৬০ থেকে ৭০টি আসন ছাড়ার পক্ষে বিএনপি। আসন নিয়ে প্রাথমিক দরকষাকষি শুরু হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি। দু’একদিনের মধ্যেই দুই জোটের শীর্ষ নেতারা আসন নিয়ে আলোচনায় বসবেন শরিকদের সঙ্গে।
মহাজোটে জটিল সমীকরণ: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন বণ্টন ও প্রার্থিতা নিয়ে জটিল সমীকরণ চলছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের মধ্যে।
সর্বশেষ এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি মহাজোটের হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয়ায় এ সমীকরণ আরো জটিল হয়েছে। জাতীয় পার্টি একাই ১০০ আসন চাইবে বলে জানা গেছে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতারা জানান, আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে এখনো পৌঁছানো যায়নি। নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরো কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। ১৪ দলের শরিক দলের একাধিক শীর্ষ নেতা আলাপকালে জানান, বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট আগামী নির্বাচনে আসবে কিনা সেই অপেক্ষায় ছিলেন তারা। এখন তারা যেহেতু নির্বাচনে আসছে তাই আসন বণ্টনের বিষয়ে পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে সিদ্ধান্তের কিছুটা পরিবর্তনও হবে। তবে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি করে যত বেশি আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা যায় সেই লক্ষ্য থাকবে বলে জোটের নেতাদের বক্তব্যে আভাস পাওয়া গেছে।
এক্ষেত্রে জোটের প্রায় সব দলের নেতারাই বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার আসনের দাবি বেশি থাকবে তাদের। ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নির্বাচনে আগ্রহী জোটের দলগুলোর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি আসনের জন্য জোর দাবি করা হতে পারে। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোটের কোন কোন দল ইতিমধ্যে ১০০টিরও বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে। তবে, জোটের নেতারা বলছেন, আসন দাবির ক্ষেত্রে তাদের দাবির সবটুকু পূরণ সম্ভব হবে না- এমন বাস্তবতা মেনে নিচ্ছেন তারা। তারা আরো বলছেন, নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত হলে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) সহ অন্য দলগুলোর সন্তুষ্টির বিষয়টি নিয়েও যেমন ভাবতে হবে, তেমনি বাস্তবতা বিবেচনায় প্রত্যাশা ও ধারণার বাইরে আসন দাবি করাও সমীচীন হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি কিছুটা জটিল সমীকরণে পড়েছে বলে মনে করেন তারা।
১৪ দলীয় জোটের একাধিক শীর্ষ নেতা আলাপকালে মানবজমিনকে জানান, বিএনপি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয়ায় আওয়ামী লীগ এখন তাদের নির্বাচনী জোটকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এগুবে। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি (এরশাদ), বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট, নাজমুল হুদার নেতৃত্বে বিএনএ (বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স), আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বিএনএফ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট) সহ আরো কিছু ছোট দল ও জোট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনী জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তাদের বিষয়েও আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে। এতে করে জোটের কিছু শরিক দলের আসন সংখ্যা হয়তো কমে আসতে পারে। তবে, আওয়ামী লীগের বৃহৎ নির্বাচনী জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টি অন্তর্ভুক্ত হলে জাতীয় পার্টিকে বেশি আসনে ছাড় দেয়ার বিষয়ে আপত্তি থাকতে পারে- এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে। নেতারা বলছেন, বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে রাজপথে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিলেন। এক্ষেত্রে জোটের শীর্ষ দলের কাছে তাদের দাবি রয়েছে। এখন সেই দাবির কতটুকু পূরণ হয় সেই অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, সর্বোচ্চ ৫০টি আসনে আমাদের জোরালো দাবি থাকবে।
জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম আলাপকালে মানবজমিনকে বলেন, ‘রোববার পর্যন্ত আমাদের দলের ৭১ জন মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। এর মধ্যে বিজয়ী হওয়ার মতো ২০ থেকে ২৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। এই কয়েকজনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের দাবি থাকবে। আমাদের মতে জয়লাভের মতো ক্লিন ইমেজের প্রার্থী তিনি যে দলেরই হোন না কেন তাকে মনোনয়ন দেয়া জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে আমরা রাজপথে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সক্রিয় ছিলাম। বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও মোকাবিলা করেছি।
তাই, আওয়ামী লীগের কাছে আমরা দাবি করতেই পারি।’ প্রার্থী বাছাই ও আসন বণ্টনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সমীকরণ জটিল হয়ে পড়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জটিল তো নিশ্চয়ই। তবে, সমীকরণ জটিল হলেও আমরা মনে করি দেশ ও জাতির স্বার্থে সকল দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- এটি শুভ লক্ষণ। গণতন্ত্রের জন্যও এটি একটি ভালো দিক। সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত হবে। মহাজোট গঠিত হলে এরশাদের জাতীয় পার্টির আসন দাবির বিষয়ে শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উনি (এরশাদ) একশ’, দেড়শ’ আসন দাবি করতে পারেন। কিন্তু যতই দাবি করুন বাস্তবতা হলো বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী তার তেমন বেশি নেই। রংপুরেও ওনার অবস্থান এখন আগের মতো নেই। আগের অবস্থানের অনেকটাই এখন পরিবর্তন হয়েছে। উনি প্রার্থী দিতে পারেন কিন্তু বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী কতজন আছে সেটি দেখতে হবে। এ বাস্তবতা তাকে বুঝতে হবে।’ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘জোটে আসন বণ্টন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যেই বিষয়টির সুরাহা হয়ে যাবে বলে আশা করি। এবার আমাদের দলের ১০ জন প্রার্থীর প্রার্থিতা চাইবো।’
গত রোববার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বেশকিছু দল নির্বাচন কমিশনে আলাদা চিঠি দিয়ে নৌকা ও তাদের দলীয় প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে চিঠি দিয়েছে। দলগুলো হলো- আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, জাতীয় পার্টি (জেপি), কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদ (রেজা)। এ ছাড়া নিবন্ধনহীন বাংলাদেশ জাসদও (আম্বিয়া) নৌকা প্রতীকে ভোটে আগ্রহ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ন্যাপের (মোজাফ্ফর) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের তরফে জানা যায়নি। ইতিমধ্যে নৌকা ও দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়ার বিষয়ে ইসিকে আমরা চিঠি দিয়েছি। আর আমাদের দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ১৫ জনকে মনোনয়নপত্র দিয়েছি। এর মধ্যে একাধিক প্রার্থী আছেন যারা নির্বাচনে জয়লাভ করে আসতে পারবেন। জোটের অন্য শরিকেরাও কেউ কেউ ৫, ১০, ১৫টি বা এর বেশি আসন দাবি করেছে। মনোনয়নপত্রও বিতরণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসায় জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবো আমরা। আমরা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। তাদের সঙ্গে থেকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। আমাদেরও দাবি থাকতে পারে। এখন আওয়ামী লীগ বড় ভাইসুলভ আচরণ করবে বলে জোটের নেতাদের প্রত্যাশা।
আর আসন ভাগাভাগির বিষয়ে সবকিছুই নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর।’ জাসদের (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার মানবজমিনকে বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা ৬টি আসন পেয়েছিলাম। এবার অবশ্যই আমরা আরো বেশি আসন চাইব। ইতিমধ্যে আমাদের দলের পক্ষ থেকে ১শ’র বেশি মনোনয়ন ফরম কিনেছেন আমাদের প্রার্থীরা। তবে, কতটি আসনে দাবি থাকবে সেটি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। বেশি আসনের দাবি থাকবে এটি বলতে পারি। আর আসন বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হবে।’ এরশাদের জাতীয় পার্টির ১০০ আসন দাবির বিষয়ে আপত্তি তুলবেন কিনা- এমন প্রশ্নে শিরিন আখতার মানবজমিনকে বলেন, ‘সেটি পরিস্থিতি দেখে বলা যাবে, এখনই বলা যাবে না।’ ১৪ দলীয় জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের দলের ২৭ জন প্রার্থীর বিষয়ে একটি তালিকা আমরা প্রস্তুত করেছি। গত নির্বাচনে যেহেতু আমরা কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারিনি, তাই এবারের নির্বাচনে প্রত্যাশা থাকতেই পারে। আর জোটের শরিক হিসেবে কিছু না কিছু আসন তো আমাদের দিতেই হবে।’
সর্বোচ্চ ৭০ আসনে শরিকদের ছাড় দেবে বিএনপি
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৭০ আসনে ছাড় দেয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। তবে এখন পর্যন্ত আসন বণ্টনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিএনপিকে এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জ। আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতায় রয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক জোটের শীর্ষ দল বিএনপি। যদিও জোটবদ্ধ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তাদের নতুন নয়। কিন্তু এবার বিএনপিকে সামাল দিতে হবে জটিলতর এক জোট-রাজনীতি। বিএনপি শরিক দলগুলোর পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
তাই হিসাবটা কিছুটা কঠিন। অতীতে জোটের শরিক দল জামায়াতের সঙ্গে আসন বণ্টনকে কেন্দ্র করে দলে নেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা কোন্দল। এবার কোন দল কতটা আসনে লড়বে তা নিয়েই চলছে দরকষাকষি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের পাঁচটি দলের মধ্যে বিএনপি বাদে বাকি দলগুলো ১৫০ আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা ভাবছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোও প্রার্থী দিতে চায় ১৫০ আসনে। প্রতিটি দলই মনে করছে নিজেদের যথেষ্ট ভোট রয়েছে ওইসব আসনে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি কতটি আসনে জোট শরিকদের ছাড় দেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়। এবার জোটের পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ে। ফলে অনেক বেশি ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়েই তাদের চূড়ান্ত করতে হবে প্রার্থী মনোনয়ন। কৌশলে শান্তিপূর্ণভাবেই মেটাতে হবে শরিক দলগুলোর আসন চাহিদা। চারদলীয় জোটবদ্ধভাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শরিকদের ৪১টি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। এবার একই সঙ্গে দুটি জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করছে বিএনপি। দুই জোটের শরিকদেরই আসনের চাহিদা বেশি। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার বিএনপিকে অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি আসন ছাড়তে হবে।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে মুখরিত থাকলেও দলটির দফায় দফায় নির্বাচনী মাঠ জরিপ করেছে নীরবে। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নানা মাধ্যমে পরিচালিত এসব জরিপে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাংগঠনিক অবস্থান, জনপ্রিয়তা, প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে কয়েকটি তালিকা তৈরি করেছিল দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তারই অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দলের পদপদবিতে না থাকা কিন্তু এলাকায় জনপ্রিয় কিছু নেতাকেও দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর একদিকে সংলাপের তোড়জোড় চললেও অন্যদিকে নিজস্বভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠের অবস্থান যাচাই করেছে বিএনপি। এতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতাদের ৬০টি আসন পাওয়া যায়, যেখানে দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছাড় দেয়া যায়। কিন্তু প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও জাতীয় রাজনীতি বিবেচনায় তার সঙ্গে ১০টি আসন যোগ করে সর্বোচ্চ ৭০টি আসনে ছাড় দেয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর চাহিদা রয়েছে অন্তত ২০০ আসনের। নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই প্রতিটি দল তাদের প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জোরালোভাবে।
এদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কাছে প্রার্থী তালিকায় চায় বিএনপি। সে অনুযায়ী দলগুলো সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা জমা দিয়েছে। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো দুয়েকদিনের মধ্যে তাদের তালিকা দেবে। সব শরিক দল থেকে তালিকা পাওয়ার পর সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থীদের আসন চূড়ান্ত করা হবে। নেতারা জানান, তিন ক্যাটাগরিতে বণ্টন হবে নির্বাচনী আসন। প্রথমত, যেসব আসনে বিএনপির শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান ও প্রার্থী রয়েছে সেসব আসনের প্রার্থী তালিকা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব আসনে জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান ও প্রার্থী রয়েছে সেগুলো নিয়েও অযথা জটিলতা করবে না বিএনপি। তৃতীয়ত, যেসব আসনে বিএনপি ও জোটের শরিকদের শক্ত অবস্থান এবং প্রভাবশালী প্রার্থী রয়েছে কিংবা জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে ঐক্য ধরে রাখতে ঐক্যফ্রন্ট ও শরিক দলগুলোর প্রার্থীদের ব্যাপারে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে সবক্ষেত্রেই মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে দলগত ও ব্যক্তিগত ভোটব্যাংকের হিসাব। পাশাপাশি বিএনপি প্রার্থী থেকে যোগ্য এবং ভোট টানতে সক্ষম প্রার্থীরা মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা পাবেন। বিএনপি সূত্র জানায়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে সমন্বয়ক করা হয়েছে আসন বণ্টনের।
আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত হবে। বিএনপি নেতারা বলছেন, এবার সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। এ বিষয়টি জোটের সব শরিকের মনে রাখতে হবে। আসন বণ্টনের ব্যাপারে সবাইকে দেখাতে হবে সর্বোচ্চ উদারতা। অন্যদিকে জামায়াতের এক নেতা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত জোটের সমর্থন পেয়েছিল ৩৩টি আসনে। চারটি আসনে বিএনপি-জামায়াত লড়েছিল যৌথভাবে। কিন্তু এবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় জামায়াত ছাড় দেয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে আসন চাইবে। তবে ২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় বড় দল হিসেবে বিএনপিও নিশ্চয়ই আমাদের বিষয়টি সম্মানের সঙ্গে বিবেচনায় রাখবে।
বিএনপি সূত্র জানায়, ২০ দলীয় শরিকদের মধ্যে জামায়াতের দাবি ৫০ আসন। জোটের অন্য শরিক দলগুলো ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও নিবন্ধন হারানো জামায়াত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। জামায়াত সূত্র জানায়, ঠাকুরগাঁও-২ আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ আবু হানিফ, দিনাজপুর-৬ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-২ মনিরুজ্জামান মন্টু, রংপুর-৫ গোলাম রব্বানী, কুড়িগ্রাম-৪ মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, গাইবান্ধা-১ মাজেদুর রহমান, গাইবান্ধা-৩ আবদুর রশিদ সরকার, গাইবান্ধা-৫ মাওলানা আমজাদ হোসেন, চাঁপাই নবাবগঞ্জ-৩ নুরুল ইসলাম বুলবুল, রাজশাহী-১, সিরাজগঞ্জ-৪ রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-১ ব্যারিস্টার নজিবুল্লাহ মোমিন, ঝিনাইদহ-৩ অধ্যাপক মতিউর রহমান, যশোর-২ আবু সাঈদ মো. শাহাদাত হুসাইন, বাগেরহাট-৪ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, খুলনা-৫ মিয়া গোলাম পরোয়ার, খুলনা-৬ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সাতক্ষীরা-২/৩, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর-১ শামীম সাঈদী, সিলেট-৫/৬, কুমিল্লা-১১ ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, চট্টগ্রাম-১৫ আ ন ম শামসুল ইসলাম, কক্সবাজার-২ হামিদুর রহমান আজাদ জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্র নির্বাচনে বিরোধী জোটের সমর্থন চাইবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এবার তাদের জন্য বরাদ্দ হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫ আসন। তবে ফরিদপুর, শেরপুর ও রংপুরের আসনগুলোতে লড়তে চায় না জামায়াত। সূত্র জানায়, এলডিপির তালিকায় চট্টগ্রাম-১৪, চট্টগ্রাম-১১, চট্টগ্রাম-১৫, চট্টগ্রাম-৭, লক্ষ্মীপুর-১, কুমিল্লা-৭, কুমিল্লা-৫, নেত্রকোনা-১ ও মেহেরপুর-২ গুরুত্ব পাচ্ছে। জাতীয় পার্টির (জাফর) তালিকায় গাইবান্ধা-৩, পিরোজপুর-১সহ ৭টি আসনের প্রার্থীকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা ৩০টি আসনের একটি তালিকা দিয়েছি। সেখানে অন্তত ১০ জন রয়েছেন যারা সাবেক এমপি-মন্ত্রী এবং যারা নির্বাচনের মাঠে অত্যন্ত শক্ত প্রার্থী। তবে বিএনপি সূত্র জানায়, ৪-৫টি আসন পেতে পারে এলডিপি। অনিবন্ধিত জাতীয় পার্টির (জাফর) দাবি অন্তত ১৫ আসন। তাদের চারটি আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। এর বাইরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে ২-৩টি, বিজেপিকে ১টি, জাগপাকে ১টি, কল্যাণ পার্টিকে ১টি ও খেলাফত মজলিসকে ১টি আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাঁচ দল ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কেউ-ই অংশ নেয়নি। মনোনয়ন নিশ্চিত থাকার পরও মহাজোট ছেড়ে এসেছেন জাতীয় পার্টির (জাফর) নেতারা। অনেক নেতা সরকারের তরফে টোপ এবং চাপ সত্ত্বেও বিএনপিকে ছেড়ে যায়নি। ফলে তাদের মূল্যায়নের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
আসন বণ্টন নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা কোনো তালিকা দেইনি। তবে ৪০টি আসন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আর এখন পর্যন্ত আসন বণ্টন নিয়ে কোনো কমিটি বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া গণফোরাম ৩০, জেএসডি ৩০, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২০টি আসন চায়। তবে তাদের জন্য ১৫টি আসন ছাড় দেয়া হবে। ভোটের আগে জাতীয়ভাবে পরিচিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলে তাদের জন্য ছাড়া হবে পাঁচটি আসন। সবমিলিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জন্য ছাড় দেয়া হবে ২০ আসন। বিএনপি সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম ৩-৪টি আসনে সমর্থন পেতে পারেন। অনিবন্ধিত এ দলটির আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও উপদেষ্টা এসএম আকরাম জোটের মনোনয়ন পেতে পারেন।
বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ভোট ব্যাংক, প্রভাবসহ নানা বিবেচনায় দলটিকে টাঙ্গাইলের দুইটি আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে। কাদের সিদ্দিকী, দলের সাধারণ সম্পাদক হাবীবুর রহমান বীরপ্রতীক ও যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী জোটের মনোনয়ন পেতে পারেন। এছাড়া জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সহ-সভাপতি তানিয়া রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনের জোটের মনোনয়ন পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। ঐক্যফ্রন্টের শরিক বিকল্পধারা বাংলাদেশ (একাংশ) ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিকল্পধারা বাংলাদেশ একাংশের চেয়ারম্যান প্রফেসর নুরুল আমিন ব্যাপারি একটি আসনে মনোনয়ন পেতে পারেন।