সংলাপে কতটা ছাড় দিতে পারে বিএনপি?

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


বিবিসি:বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট কতটা ছাড় দিতে রাজী হবে? যে সাত দফা দাবি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের তরফ থেকে পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি যদি সরকার না মানে, সেক্ষেত্রে কি তারা নির্বাচনে যাবে?

বিএনপির নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে এখনই কোন মন্তব্য করতে রাজী নন।

বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আলোচনার আগেই তো আমি আপনাদের বলতে পারবো না, কোন জায়গায় পৌঁছাবো, কোন জায়গায় ছাড় দেব, কোন জায়গা ছাড়বো না। এটা তো আমার পক্ষে এখনই বলা সম্ভব না। আলোচনা হবে। যদি দেখা যায় যে আলোচনা ফলপ্রসু হচ্ছে, তখন পুরো বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হবে।”

বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে সরকার এবং নবগঠিত বিরোধী জোট ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের’ মধ্যে এই সংলাপ হতে যাচ্ছে আগামীকাল।

জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট তাদের সাত দফা দাবি নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছিল। তার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে সংলাপের আমন্ত্রণ পাঠান বিরোধী দলের কাছে।

বাংলাদেশে অবশ্য গত কয়েক দশকে সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর এধরণের যত সংলাপ হয়েছে, তার কোনোটিতেই সমঝোতা হবার কোন নজির নেই। তাই এবারের সংলাপের পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে এরই মধ্যে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যে দুটি দাবির ব্যাপারে সরকার অনড় অবস্থান নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তার একটি নির্দলীয় সরকার, অপরটি খালেদা জিয়ার মুক্তি।

খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি এখন আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমানও দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়েছেন, লন্ডনের নির্বাসিত জীবন থেকে তার দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এই দুজনকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যদি সরকার অন্য কিছু দাবি মেনেও নেয়, তাহলেও কি খালেদা জিয়ার জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে? এটিকে ‘হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন’ হিসেবে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আলোচনার আগে এধরণের কোন মন্তব্য করা কোনভাবেই সমীচীন নয়।”

জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের সাত দফা দাবিকে একটি প্যাকেজ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হাজার হাজার কর্মী যখন জেলখানায়, দলের নেত্রী এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা যখন জেলে বন্দী, তখন নির্বাচন কখনোই অর্থবহ হবে না। সেজন্যেই আমি বলছি আলোচনার মাধ্যমে এটির সমাধান করার কথা।”

আগের রাজনৈতিক সংলাপগুলো কতটা সফল ছিল?
বিবিসি; ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:২৬

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার পর একমাত্র ২০০১ সালের নির্বাচন ব্যতীত অন্য সব নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য দেখা গেছে। অতীতে এর আগ অন্তত তিনবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা কিংবা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দুবার হয়েছে বিদেশীদের মধ্যস্থতায়।

কী হয়েছিল সেসব আলোচনায়?

১৯৯৪ সালের আলোচনা
১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি সংসদীয় উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে আনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনে আওয়ামী লীগ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। হরতাল এবং সহিংসতায় জনজীবন তখন বিপর্যস্ত।

তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্র সংহত করতে কমনওয়েলথ-এর তরফ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় আসেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টেফান। কিন্তু সে আলোচনাও সফল হয়নি।

স্টেফান তখন ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে দফায়-দফায় বৈঠক করেন।এক পর্যায়ে তিনি সর্বদলীয় একটি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সে সরকারে সরকার এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি মন্ত্রীসভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

এছাড়া একজন টেকনোক্রেট মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ফর্মুলা মানেনি। স্যার নিনিয়ান স্টেফানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও তুলেছিল আওয়ামী লীগ। কোন রকম সমাধানে না আসার কারণে ফিরে যান স্টেফান।

এরপর আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলন আরো জোরদার করে এবং বিএনপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা এবং বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য সে নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধনের করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে কয়েক মাসের মধ্যেই আবারো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আব্দুল জলিল ও আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া সংলাপ
২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সংসদ ভবনে সংলাপে বসেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ একটি প্রস্তাব তুলে ধরে।

প্রথম দিনের আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বলেন, “১৪ দলের পক্ষ থেকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের যে দাবিগুলো আছে সেগুলো আমার কাছে হস্তান্তর করেছেন। আমি তাদের প্রত্যেকটি দাবি সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছি। তিনি ব্যাখ্যা ব্যাখ্যা করেছেন। আমি এ ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে আমার দলের কাছে ফেরত যাব এবং দলের সাথে আলোচনা করবো।”

এ সময় আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল।

জলিলও একই কথা বলেছেন। প্রথম বৈঠকের পর তারা জানিয়েছেন যে আলোচনা আরো চলবে। তখনকার সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে দুটি দাবিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়।

প্রথমত; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের না থাকা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে এমএ আজিজের পদত্যাগ। কিন্তু এ দুটি বিষয়ে কোন বিএনপির দিক থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া আসেনি।

একদিকে আওয়ামী লীগ রাস্তায় আন্দোলন করতে থাকে এবং অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি ২০০৭ সালের ২২শে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখ বিচারপতি কেএম হাসান প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এক পর্যায়ে বিরোধী রাজনৈতিক জোট নির্বাচন থেকে সরে যায়।

শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ফলে প্রায় দুই বছর সেনা-সমর্থিত সরকার দেশ পরিচালনা করে।

অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর থেকে সে ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির দিকে আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়।

২০১৩ সালের শুরুতে সে আন্দোলন জোরালো রূপ নেয়। বিরোধী দলে বিএনপির ডাকা হরতাল অবরোধের কারণে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। দেশজুড়ে এ সময় সহিংসতাও হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ততদিনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে।

তারানকো ঢাকা অবস্থানকালে বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখেই নির্বাচনের একটি ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি। কিন্তু বিএনপি সে বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখায় নি।

তারানকো তার সফরের সময় বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছেন। এর পাশাপাশি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথেও তিনি বৈঠক করেন।

এর পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাথে নিয়ে একটি বৈঠক করেন। কিন্তু উভয়পক্ষ তাদের দাবিতে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত কোন সমাধান ছাড়াই ফিরে যান তারানকো। যাবার আগে সোনারগাঁও হোটেলে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উভয়পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজী হয়েছে।

কিন্তু তারানকোর কথায় পরিষ্কার আভাস মিলেছিল যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোন সমাধান সূত্র বের হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে আসে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত এক নির্বাচন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *