ঢাকা: আলোকিত মানুষ ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। আজ তাঁর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৩ সালের এ দিনে রাজধানীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চলে যান প্রভূর সান্নিধ্যে। সাংবাদিকতা অঙ্গনে, দেশ ও জাতির নানা সংগ্রামে, সংকট উত্তরণে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার অংশগ্রহণ অনুপ্রাণিত করত আমাদের মত অনুজদের।
‘গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভয়েস অব আমেরিকা, ঢাকা, বাংলাদেশ’। ভরাট ও দরাজ কন্ঠটি এখনো যেন কানে বাজে। এ কন্ঠ শুনে শুনেই সাংবাদিকতার প্রতি মোহবিষ্ট হয়েছি। তাঁর স্নেহ ও পরামর্শকে পাথেয় করে পেশাকে- নেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। সাংবাদিক ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রেও প্রেরণা পেয়েছি এই কিংবদন্তী সাংবাদিকের কাছ থেকে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের বার বার নির্বাচিত সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছিলেন অগ্রসেনা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অকুতোভয় নেতা। একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, আগ্রাসন ও ঘৃণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনেও কঠোর ও আপসহীন ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতের বাইরেও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তার কাছে সমান মর্যাদায় সমাদৃত হতেন।
সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ২১ জুলাই ফেনীর শর্শদি চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন গিয়াস কামাল। ঢাকা টাইমস পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন তিনি। এর পর তিনি তৎকালীন মর্নিং নিউজে কাজ করেছেন। পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগদান করেন। বাসসে যোগদানের পর বাসসের কার্যক্রম দেশে ও বিদেশে সম্প্রসারিত হয়। এ ছাড়া ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকা সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বনন্দিত সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ভয়স অব আমেরিকায় তার বলিষ্ঠ প্রতিবেদনে প্রকম্পিত ছিল স্বৈরশাসকের ‘তখত-ই তাউস’। চোখে না দেখা গেলেও ভয়েস অব আমেরিকায় তার কণ্ঠে আন্দোলিত হতো এ দেশের শহর-বন্দর, হাট-ঘাট, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। ‘গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভয়েজ অব আমেরিকা, ঢাকা’ বাক্য সারা দেশের মানুষের খবরের তৃষ্ণা মেটাত।
ছাত্রজীবন থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন তৎপর। পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতি, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, মৌলিক অধিকার, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে তিনি যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিক দলন ও সংবাদপত্র প্রকাশের বিরুদ্ধে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
সাংবাদিক হিসেবে যেমন নিষ্ঠাবান ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, তেমনি দায়িত্ব পালন করেছেন দেশ ও জাতির জন্য। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধে তিনি সারা জীবন মানবতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাবের কয়েকবার নির্বাচিত সভাপতি ছাড়াও বাসস পরিচালনা বোর্ডের নির্বাহী সদস্য ও সার্ক সাংবাদিক ফোরাম এবং বিদেশে সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেবামূলক কাজের জন্য তিনি জীবনে বহু সম্মাননাসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত হন। গিয়াস কামাল ছিলেন এক জ্ঞানভাণ্ডার। জ্ঞানের যে কোনো শাখায় তার ছিল অবাধ পদচারণা। সাংবাদিকদের সম্পর্কে তিনি বলতেন, একজন সত্যিকার সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই (Areal journalist has got no friend)। সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। বিপদগ্রস্ত মানুষ যখন আদালতেও বিচার পায় না তখনই তারা শেষ অবলম্বন হিসেবে প্রেসক্লাবের দ্বারস্থ হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি এমন কথাই বলতেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের শিক্ষক-মহাগুরু। রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর শিষ্য। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাদের এ দেশের মানুষের প্রকৃত নেতা মানতেন।