ঢাকা: তাজরীন ফ্যাশন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কর্মপরিবেশ উন্নয়নে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাওয়া পোশাক খাতের সামনে এবার আরো বড় সংকট অপেক্ষা করছে। তা হলো, পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকা তাদের পোশাক নিজেদের দেশেই প্রস্তুত করতে চেষ্টা করছে। নিজেদের দেশে না হলেও নিকটবর্তী দেশে (নিয়ারশোরিং) অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পোশাক প্রস্তুত করবে তারা। টেকসই উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তারা দূরবর্তী (অফশোর) উৎসগুলো থেকে বেরিয়ে আসবে।
এ সংকটের কথা জানিয়েছে বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেন্সি অ্যান্ড কম্পানি। এই অক্টোবরে ম্যাকেন্সির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ-আমেরিকার পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা নিশ্চিত যে এই পরিবর্তন আসন্ন। ২০২৫ সালের মধ্যে তারা তাদের ৫০ শতাংশের বেশি পোশাক সংগ্রহ করতে চায় নিয়ারশোর উৎস থেকে। তারা এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
‘পোশাক প্রস্তুতকরণ শিল্প দেশে ফিরবে কি?’ এই শিরোনামের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে গত সেপ্টেম্বরে ম্যাকেন্সির এক জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি মেক্সিকোতে পোশাক প্রস্তুত করে তাদের দেশে নিতে পারে, তবে প্রতি জোড়া জিন্সের খরচ চীনের তুলনায় ১২ শতাংশ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে অফশোর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি জোড়া জিন্সের খরচ ধরা হয়েছে ১০.৬৮ ডলার, চীনের ক্ষেত্রে ১২.০৪ ডলার। যেখানে মেক্সিকো থেকে নিলে খরচ পড়বে ১০.৫৭ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেদের দেশে উৎপাদন করে, তবে খরচ পড়বে ১৪.০৫ ডলার। এ ক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণের সময়ও বাঁচবে তাদের। মেক্সিকো থেকে মাত্র দুই দিনের মধ্যে তারা পণ্য নিতে পারবে। যেখানে চীন বা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে সময় লাগে ৩০ দিন।
ইউরোপে জার্মানি যদি তুরস্কে নিয়ারশোরিং কারখানা গড়ে তোলে তবে তাদের পণ্যের খরচ বাঁচবে ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতি জোড়া জিন্সের খরচ ধরা হয়েছে ৯.৯৪ ডলার, চীন থেকে ১২.৪৬ ডলার, তুরস্ক থেকে ১২.০৮ ডলার এবং জার্মানি যদি নিজের দেশে কারখানা করে তবে পড়বে ৩০.৩৬ ডলার। জাহাজীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীনের পণ্য নিতে সময় লাগবে ৩০ দিন, তুরস্ক থেকে লাগবে তিন থেকে ছয় দিন।
দুই দশক আগে আমেরিকা ও ইউরোপের পোশাক ব্র্যান্ডগুলো এবং তাদের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি উৎপাদনের জন্য এশিয়ার দিকে যতটা সম্ভব ধাবিত হতে শুরু করে। যাতে তারা তুলনামূলক সস্তায় পণ্যগুলো পায়। তখন থেকে তারা চীনের থেকেও বেশি সস্তায় পণ্য পেতে অন্যান্য উৎস দেশ খুঁজতে থাকে। যেসব পোশাক ব্র্যান্ড এটা সফলভাবে করতে পেরেছে, তারা তাদের ভোক্তাদের তুলনামূলক কম দামে দ্রুত মানসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণেই ম্যাকেন্সি প্রশ্ন তুলেছে, ‘পোশাক প্রস্তুত কি নিজেদের দেশে সম্ভব হবে?’
বর্তমানে পোশাক শিল্পটা আন্তর্দেশীয়। এখানে দ্রুতগতিতে পণ্য ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে ন্যূনতম সাশ্রয়ের চিন্তা বাদ দিতে হচ্ছে পোশাকের ব্র্যান্ডগুলোর। মৌলিক পরিপালনীয় বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে টিকে থাকার কৌশলে রূপান্তরিত হয়েছে। এ কারণে তাদের প্রচলিত সরবরাহ চেইনগুলো সমস্যার মুখে পড়েছে। কারখানার শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখন ব্র্যান্ড এবং রিটেইলারগুলো পণ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতকরণ মডেল নিয়ে আরো বিষদভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছে। এখন তারা নিকটবর্তী দেশগুলো থেকে পণ্য সংগ্রহ বাড়ানো এবং আরো স্বয়ংক্রিয় প্রস্তুত পদ্ধতির দিকে যাচ্ছে, যাতে রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সম্ভাবনা।
পোশাকের বড় বড় ব্র্যান্ড যারা উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে এবং আরো বেশি টেকসই করতে স্বেচ্ছায় এই অটোমেশন টেকনোলজি গ্রহণ করবে তারাই সম্ভবত ভবিষ্যতের বিজয়ী হবে। এসব তথ্য উল্লেখ করে ম্যাকেন্সির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের পোশাকের বড় দুটি উৎস চীন এবং বাংলাদেশ। আমেরিকার বড় দুটি উৎস চীন এবং ভিয়েতনাম। ম্যাকেন্সি এবং জার্মানির আরডাব্লিউটিএইচ অ্যাচেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে অংশ নেওয়া এক-চতুর্থাংশ পোশাক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বলেছেন, তাঁরা আশা করেন ২০২৫ সালের মধ্যে তাঁরা নিয়ারশোরিং উৎস থেকে অর্ধেক পোশাক সংগ্রহ করতে পারবেন। এর অর্থ হলো এশিয়া থেকে পশ্চিমা পোশাকের উৎস সরে নিকটবর্তী দেশগুলোতে চলে যাবে।
জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ৫ শতাংশ আছে যাদের বর্তমানে (২০১৮) অফশোর উৎস ৩৩টি, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা নিয়ারশোরিং তিনটি উৎস তৈরি করবে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর বর্তমানে ১৮টি অফশোর আছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা নিয়ারশোরিং উৎস ১৫টিতে নিয়ে যাবে। ১০ থেকে ২০ শতাংশ আছে যারা বর্তমানের ১৫টি অফশোর উেসর জায়গায় ২০২৫ সালে ২২টি নিয়ারশোরিং উৎস করবে। ৫০ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণকারী বলেছে, তাদের বর্তমানে ২১টি অফশোর উৎস রয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা ২৪টি নিকটতম উৎস করবে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বল্প দামের এবং মাঝারি মানের পোশাক উৎপাদনের জন্য এটা লাভজনক কৌশল হবে না। তাদের প্রতিনিয়ত স্বল্প ব্যয় এবং স্বল্প সময়ে বিপণনের মধ্যে সমঝোতা করতে হবে। সম্প্রতি চীনে মজুরির হার বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ আমেরিকার পোশাকের ক্রেতারা তুলনামূলক সস্তায় পণ্য কিনতে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মতো দেশে যেতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক বিক্রয় কমতে শুরু করেছে। তবে নিয়ারশোরিং উেসরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কারণ পণ্য দ্রুত সরবরাহ করার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে এবং ভোক্তারা দিন দিন অফশোর দেশগুলোর শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি এবং পরিবেশের ক্ষতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮২ শতাংশ সোর্সিং ম্যানেজার বলেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে সাদামাটা পোশাক তৈরির প্রক্রিয়াটি পুরোপুরিভাবে অটোমেশনে চলে আসবে। যদি তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়, তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার ঘরে ফিরবে পোশাক কারখানা। তবে এতে কর্মসংস্থান হবে না। চীনের পোশাক কম্পানিগুলো এখন ইথিয়োপিয়ার মতো ইউরোপের নিকটবর্তী দেশে যেখানে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় সেখানে কারখানা করছে।
এ নিয়ে ব্লুমবার্গের এক মতামতে বলা হয়েছে, নিজেদের ঐতিহ্যকে নাড়া দিতে এবং সরবরাহ চেইনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে নিয়ারশোরিং উেসর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে নিয়ারশোরিং, অটোমেশন এবং টেকসই সরবরাহ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। চাহিদাকেন্দ্রিক পোশাক ভ্যালু চেন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের মধ্যে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে (পাঁচ হাজার ডলার) উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে বছর দুয়েক আগে। বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে দেশটি আয় করেছে তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ডলারের দর বেড়ে চলেছে। এতে করে বাংলাদেশের তুলনায় এর প্রতিযোগী দেশগুলো বিশেষ করে ভারতের রুপির অবমূল্যায়ন হওয়ায় তাদের রপ্তানিকারকরা বেশি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যয়ান হয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ, ভারতে হয়েছে সেখানে ১০ শতাংশের বেশি। এতে করে সে দেশের রপ্তানিকারকরা এক ডলারের পণ্য বিক্রি করে আগে যেখানে ৬৫ রুপি পেত এখন পাচ্ছে ৭৪ রুপির বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা এক ডলারের পণ্য বিক্রি করে বছরখানেক আগে যেখানে ৮০ টাকা পেত, তারা এখন পাচ্ছে ৮৪ টাকা। এতে করে ভারতের পোশাক রপ্তানিকারকদের পক্ষে তুলনামূলক কম দামে পোশাক রপ্তানির সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘রুপির দরপতন যদি দীর্ঘ হয় তবে সেটা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে আশা করা যায়, এই দরপতন খুব একটা দীর্ঘ হবে না।’
দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। জিডিপিতে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের অংশ ৬.৫ শতাংশ। যেখানে প্রথম অবস্থানে থাকা চীনের অংশ ৩৪.৪ শতাংশ। ৫.৯ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। ভারতের ৪.১ শতাংশ, তুরস্কের ৩.৩ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ১.৮ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ১.৬ শতাংশ রয়েছে পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে।