বিশেষ প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্র: মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অভাবনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। রোহিঙ্গা প্রশ্নে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এর মূলে রয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনীর এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। এটি তদন্তের সময় আন্তর্জাতিক মিশন যা প্রমাণ পেয়েছে, তাতে এই বাহিনীর জ্যেষ্ঠ সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘জেনোসাইড’ বা জাতিহত্যার অপরাধে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষে একা এ বিচার করা সম্ভব নয়। এর ভার হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অথবা ভিন্ন একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে এ কথা বলেন মিয়ানমার প্রশ্নে তথ্য অনুসন্ধানকারী নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে নিরাপত্তা পরিষদকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, শুধু রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের জনগণ নয়, সারা বিশ্ব আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ কর্তৃক গঠিত আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গত ২৭ আগস্ট প্রকাশ করা হলেও বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে তা উত্থাপন করা হয়। রাশিয়া, চীনসহ মোট চারটি দেশ এ প্রতিবেদন পরিষদের সামনে উত্থাপনে আপত্তি জানায়। তাদের যুক্তি ছিল, এ প্রতিবেদনের বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্র নিরাপত্তা পরিষদ নয়, এ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত হয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অথবা মানবাধিকার পরিষদে। পরে এ প্রশ্নে ভোটাভুটি হলে ৯-৩ ভোটে প্রতিবেদনটি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাশিয়া, চীন ও বলিভিয়া এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।
মূল বিতর্কেও রাশিয়া ও চীন মিয়ানমার প্রশ্নে তাদের আগের নমনীয় অবস্থান থেকে বক্তব্য রাখে এবং পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো বলে দাবি করে। রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া আন্তর্জাতিক কমিটির প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, প্রতিবেদনটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক। যাঁরা এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন, তাঁরা কেউ মিয়ানমার সফর পর্যন্ত করেননি। তিনি দাবি করেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নটি ব্যবহার করে একটি সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি করা হচ্ছে। রাশিয়া সে রকম উদ্যোগের বিরোধিতা করবে।
চীনা রাষ্ট্রদূত মা ঝাওখু দাবি করেন, পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো—এ কথা পরিষদের মেনে নেওয়া উচিত। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের তদন্ত করছে, সে কথা উল্লেখ করে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন একমাত্র রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মিয়ানমারকেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য বাইরের কোনো মিশনের প্রয়োজন নেই।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপরাধের পক্ষে বিচারের দাবি সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি বলেন, আন্তর্জাতিক কমিটি তাদের প্রতিবেদনে যে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত তদন্তেও অনুরূপ অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনো কোনো দেশ প্রতিবেদনটির ব্যাপারে যে সমালোচনা করেছে, তা প্রত্যাখান করে নিকি হেইলি বলেন, কারও দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য নয়। এর লক্ষ্য দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি অব্যাহত নির্যাতন বন্ধের দাবি পুনরুল্লেখ করে বলেন, এই সম্প্রদায়ভুক্ত সব সদস্যের নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে।
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ পরিষদের অধিকাংশ সদস্য প্রতিবেদনটিকে স্বাগত জানায় এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের দাবি করে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাও দো সোয়ান প্রতিবেদনটির বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর গৃহীত ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল তাঁর দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিরোধ। সে পদক্ষেপকে ‘গণহত্যা’ নামে অভিহিত করার কোনো প্রামাণিত ভিত্তি নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয় এবং রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত স্বীকার করে না।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন ছিলেন এ অধিবেশনের শেষ বক্তা। তিনি জানান, এ তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ‘গণহত্যা’র উদ্দেশ্য নিয়েই রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায়। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার করার ব্যাপারে মিয়ানমারের দায়িত্ব রয়েছে, সেই লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ বিচার–প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।
নিরাপত্তা পরিষদকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জড়িত থাকার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তা হবে রোহিঙ্গাদের প্রতি গভীর অবমাননা। তিনি রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাব গ্রহণ ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে একটি আন্তর্জাতিক তহবিল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন।
পরে প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পরিষদে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পরিষদ যে আন্তর্জাতিক তদন্ত মিশনের প্রতিবেদনটি আমলে আনে, তাতে এই সংকটের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশ বারবার বলে এসেছে, নিরাপত্তা পরিষদের ‘অভিভাবকত্ব’ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ জানান, রোহিঙ্গা প্রশ্নে সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে গত বছরের মতোই ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স) নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার প্রশ্নে বিশেষ প্রতিনিধির কার্যাবলি সম্প্রসারিত করা ও নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক একটি প্রস্তাব গ্রহণের বিবেচনা এ প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী। নভেম্বরের শেষ নাগাদ থার্ড কমিটি এ প্রশ্নে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করতে পারে বলে রাষ্ট্রদূত মাসুদ জানান।