উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। মাঝখানে ‘জলাবন’ রাতারগুল। উইকিপিডিয়ারে তথ্য মতে পৃথিবীতে ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট বা স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুটি- একটি শ্রীলঙ্কায় আরেকটি আমাদের সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল।
সিলেট থেকে দেশের একমাত্র স্বীকৃত এই সোয়াম্প ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান। অনিন্দ্য সুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের। ‘রেইন ফরেস্ট’ নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচেয়ে বড় সোয়াম্প ফরেস্ট কিন্তু ওই অ্যামাজনই। ঠিক অ্যামাজনের মতোই স্বাদুপানির বন আমাদের রাতারগুল। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় ‘মুর্তা’ বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতা গাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল।
অ্যামাজনের মতোই গাছগাছালির বেশিরভাগ অংশ বছরের চার থেকে সাত মাস থাকে পানির নিচে। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখানকার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে প্লাবিত করে পুরো রাতারগুল জলাবনকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সব সময়ই পানি থাকে বনে (মে- সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই, পাতা ঝরা শুস্ক ডাঙ্গা। আর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে চলা মেঠো পথ। আর তখন জলজ প্রাণিকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বড় বড় ডোবাগুলোতে।
বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে জলে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই জলের নিচে। কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগবে পুরো বন। মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দিবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে পথ চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হবে সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় জল বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।
বনবিভাগের তথ্য মতে, বনের আয়তন ৩৩২৫.৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে রয়েছে জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে নির্বিষ গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর। বনের ভেতর দাঁপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালী, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বণ্য প্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরো অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এই বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি।
শুকনো মৌসুমে ডিঙি নৌকায় বনের মধ্যে ঢুকলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দিবে। এ দৃশ্য আসলেই দূর্লভ! গাছের মধ্যে এখানে করচই বেশি। বটও চোখে পড়বে মাঝেমধ্যে। আর বনের দক্ষিণে মুর্তা (পাটি) গাছের প্রাধান্য। রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। এছাড়া ওদিকে ‘শিমুল বিল’ হাওর আর ‘নেওয়া বিল’ হাওর নামে দুটো বড় হাওর আছে।
বর্ষায় হাওরের স্বচ্ছ পানির নিচে ডুবে থাকা গাছগুলো দেখার অভিজ্ঞতা মনোমুগ্ধকর। শীতকালে আবার বনের ভিন্নরূপ। জল কমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মুর্তা ও জালি বেতের বাগান। সে সৌন্দর্য আবার অন্য রকম! আগেই বলেছি, রাতারগুল বনে ঢুকতে হয় ডিঙি নৌকায় চেপে। নৌকা একবার বনে ঢুকলেই আর কথা নেই! কয়েকটি মাত্র শব্দ লাগবে আপনার ভাব প্রকাশের জন্য- রুদ্ধশ্বাস, বিমুগ্ধ, বিমোহিত! আর বোনাস হিসেবে পাবেন গোয়াইন নদী দিয়ে রাতারগুল যাওয়ার অসাধারণ সুন্দর পথ; বিশেষ করে বর্ষায়। এ ছাড়া নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে দেখবেন দূরে ভারতের মিজোরামের উঁচু সবুজ পাহাড়।
যেভাবে যেতে হবে : রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে। তবে যেভাবেই যান, যেতে হবে সিলেট থেকেই। প্রথম উপায়- সিলেট থেকে জাফলং, তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে যাওয়ার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৯০০- ১৫০০ টাকার মধ্যে পাবেন (আসা- যাওয়া)। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে। এ জন্য ঘণ্টাপ্রতি খরচ হবে ২০০-৩০০ টাকা।
দ্বিতীয় উপায়- সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। ভাড়া ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট, শালুটিকর হয়ে যাওয়া এই রাস্তা বর্ষাকালে খুব সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে যেতে হবে।
তৃতীয় উপায়- সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছতে হবে। ভাড়া প্রায় ৩০০ টাকা। সময় লাগবে প্রায় এক ঘণ্টা। এরপর মটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়। এই তৃতীয় পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম।
কিছু সতর্কতা : রাতারগুল বা তার আশপাশে খাবার বা থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার গোয়াইনঘাট বা সিলেট থেকে নিয়ে যেতে হবে। আরেকটা বিষয়, নৌকায় ঘোরার সময় পানিতে হাত না দেওয়াই ভালো। জোঁকসহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো রয়েছেই, বর্ষায় বিষাক্ত সাপও পানিতে বা গাছে দেখতে পাওয়া যায়। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি। এ ছাড়া ছাতা, রোদ টুপি, সানগ্লাস, ক্যামেরা এবং চাইলে দূরবীনও সঙ্গে নিতে পারেন। এখানে বেড়ানোর নৌকাগুলো অনেক ছোট। এক নৌকায় পাঁচ জনের বেশি উঠবেন না। পলিথিন, বোতল, চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট এগুলো পানিতে ফেলবেন না দয়া করে। আমাদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।